অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রতি মায়েদের সচেতনতা

Spread the love

অটিজম একটি মস্তিষ্কের বিকাশ জনিত সমস্যা। এতে আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত তাদের বয়স অনুযায়ী জ্ঞানীয় বিকাশ বা বুদ্ধি খাটিয়ে কোন খেলা বা কোন কাজের সমস্যা সমাধান, ভাষাগত দক্ষতা অর্জন এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া করতে পারেনা। এই লক্ষণগুলো শুধুমাত্র বাচ্চাদের মধ্যেই পাওয়া যায়। অটিজমের বৈশিষ্ট্য নিয়েই একটা শিশু মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়। তাই শিশুর বয়স একটু একটু করে বাড়ার সাথে সাথে প্রকাশ পেতে থাকে এই লক্ষণগুলো। অটিজমে শিশুরা অন্য বাচ্চাদের তুলনায় আলাদা রকম আচরণ করে থাকে। যেমনঃ বারবার একই জিনিস পুনরাবৃত্তি করা, অস্থির আচরণ করা, আই কন্টাক্ট না করা। এই সমস্যা সাধারণত এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে দেখা যায়।

অটিজমের এই লক্ষণগুলো প্রকাশের সাথে সাথে মা-বাবা যদি বুঝতে পারেন এবং বাচ্চাদেরকে তখনো ইন্টারভেনশন প্রক্রিয়াটাকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারেন তাহলে বাচ্চাকে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা যেতে পারে। তাই এই বিষয়ে মা-বাবার সচেতনতা বৃদ্ধিই অপরিহার্য ভূমিকা পালন করবে। কেননা বিকাশ মূলক মাইলস্টোন গুলো ধাপে ধাপে অনেকটাই মায়ের গর্ভ থেকেই শুরু হয়ে যায়।

অটিজম হলো স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যা তাই এতে আক্রান্ত শিশুদের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে অটিজম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিশুদের জন্য একটি সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতির দরকার হয়। এ চিকিৎসা পদ্ধতিতে স্পীচ থেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্টদের ভূমিকা অপরিসীম। যেহেতু রাতারাতি এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় তাই মা বাবার জন্য পেরেন্টাল কাউন্সিলিং ভীষণ জরুরী এই কারণে যে তারা হতাশায় ভুগেন, ধৈর্য্য হারা হয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে চাইল্ড সাইকোলজিস্ট, ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি এই বাচ্চাদের খাবারের তালিকাতে কিছু বিধি নিষেধ আছে। এই সম্পর্কে যথাযথ গাইডলাইন জানতে একজন পুষ্টিবিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

তাই বয়স অনুযায়ী বিকাশমূলক মাইলস্টোন গুলোর কোনো অসামঞ্জস্যতা শিশুর আচরণে লক্ষ্য করলে মা-বাবার সচেতনতামুলক পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরা হলঃ

ভাষাগত বিকাশঃ অনেক সময় আমরা অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মায়েদের কাছ থেকে শুনে থাকি যে, বাচ্চা দুই আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত কথা বলতে পারতো, দুই একটা ছড়া বলতে পড়তো কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে আর এখন একদম পারেনা। ভাষাগত বিকাশ একটা ইউ শেপ কার্ভ এর হয়। মানে উল্টো কার্ভ। মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় পাঁচ মাসে শিশুর ভাষার বিকাশের প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে যায়, আর পিক পিরিয়ড হচ্ছে তিন বছর, অটিষ্টিক বাচ্চাদের ওরাল ভাষা ব্যাবহারের সময় না পারলেও কমিউনিকেশনে অন্য কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যম ইন্টারভেনশন দিয়ে ভাষাগত বিকাশ ঘটানো যেতে পারে।

তিনটি বিষয় খেয়াল রেখে বাচ্চার জন্য ইন্টারভেনশন প্ল্যান করতে হবেঃ

১। আন্ডারস্ট্যান্ডিং লেভেল বাড়াতে হবে
২। কমিউনিকেশন ইন্টেনডেড তৈরি করতে হবে
৩। ইমিটেশন স্কিল তৈরি করতে হবে

এক্ষেত্রে স্পীচ থেরাপিস্ট-এর কাছে নিয়ে যেতে হবে এবং তাদের দেয়া টেকনিকগুলো ধৈর্য্যের সাথে পালন করতে হবে।

সেন্সরি ইস্যুসঃ দেখা, শোনা, গন্ধ নেওয়া, এবং স্বাদ প্রতিদিনের আলাদা আলাদা একটা সেন্স। প্রতিটি সেন্স এর আলাদা আলাদা সিমটম থাকে যেমন একটা বাচ্চা যদি স্পর্শ সহ্য করতে না পারে তার মানে হচ্ছে টেকটাইলে হাইপার সেনসিটিভিটি থাকতে পারে। আবার বাচ্চাটির যে কোন প্রেসার নেওয়ার টেনডেন্সি খুব বেশী থাকে তাহলে দেখা যায় ঐ বাচ্চাটির হাইপার সেনসিভিটি থাকতে পারে। ডেইলি লিভিং এ প্রতি মুহুর্তে এক একটা আলাদা ভাবে ইমপ্যাক্ট আসে। আর এ জন্যই বাচ্চার প্রব্লেম অনুযায়ী প্ল্যান করতে হবে যে বাচ্চাকে আসলে কোন সেন্সরি ইস্যুস নিয়ে কাজ করতে হবে এবং এটির জন্য বেস্ট ওয়ে হচ্ছে সেন্সরি ইন্টিগ্রেশন থেরাপি। এ থেরাপির মাধ্যমে বাচ্চার সেন্সরি ইস্যুস গুলো কমাতে সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট্রের কাছে আপনার শিশুকে নিয়ে যেতে হবে।

শারীরিক বিকাশঃ কিছু গবেষণামূলক তথ্য থেকে দেখা গেছে যে, নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক কার্যক্রমে অটিজম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিশুরা সামাজিক বিকাশ লাভ করে। শিশুরা অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারে ও যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে, যা অটিজমের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বেশির ভাগ অটিস্টিক শিশুর মাংসপেশির সমন্বয় ও কার্যক্ষমতা দূর্বল থাকে।

হাতের আঙুলের মাংসপেশির দুর্বলতার কারণে অনেকেই পেন্সিল ধরতে পারে না বা খুব সূক্ষ্ম কাজ গুলো করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে শিশুর আঙুলের সমন্বয় ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে তাকে কাদামাটি বা ময়দার খামি দিয়ে খেলতে দিন। নিজেও তার সঙ্গে খেলায় মেতে উঠুন এবং তার প্রশংসা করুন। শিশুকে বেশী বেশী খেলাধুলায় আগ্রহী করতে যেমনঃ বল ছুড়ে দেওয়া, বাস্কেটে বল ছুড়তে বলা এই একটি কাজই বারবার করবে। প্রতিদিন একই নিয়মে একটি কাজ করলে শিশুর মনোযোগ যেমন বাড়বে, তেমনি মাংসপেশির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে শিশু আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে এবং সামাজিকভাবে অন্যদের সঙ্গে মিশতে সহজ হবে। শিশুর সঙ্গে রং নিয়ে খেলার জন্য দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন। এ সময়ে তার সঙ্গে মেতে উঠতে পারেন নানা রকমের খেলায়। তার সাথে পালা করে খেলুন। একটা ত্রিভুজ এঁকে তাতে রং করা, খেয়াল রাখতে হবে যে, শিশু যেন ধীরে ধীরে সময় নিয়ে কাজটা শেষ করে। এর ফলে তার মনোযোগ বাড়বে। মনে রাখবেন শিশুদের একমাত্র কাজ হলো খেলা। খেলার মাধ্যমেই শিশু ধাপে ধাপে স্বাভাবিক বিকাশ লাভ করে। কথা বলতে হবে, গান ও ছড়া শোনাতে হবে, ছবির বই দেখতে হবে। এক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপিস্ট ও একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট-এর সাহায্য দরকার।

পুষ্টিকর খাবার এবং খাবারের তালিকাঃ এসব বাচ্চাদের খাবারের তালিকাতে কিছু বিধিনিষেধ আছে এবং সঠিকভাবে বেড়ে উঠার জন্য কি ধরনের পুষ্টিকর খাবার দরকার এই সম্পর্কে যথাযথ গাইড লাইন জানতে একজন পুষ্টিবিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাঃ অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের সুরক্ষার জন্য একমাত্র মায়েরাই বেশিরভাগ সময় ব্যয় করে থাকেন। তারা অনেক সময় পরিবারের থেকে যথোপযুক্ত সহানুভূতি এবং সহযোগীতা থেকে বঞ্চিত হন। সে কারনেই তারা হতাশা, বিষন্নতাতে ভুগেন। নিজের যত্ন নিতে পারেন না। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে তারা তাদের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চাটিকে সঠিকভাবে ইন্টারভেনশন দিতে পারবেন না। সে কারণে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য পেরেন্টস কাউন্সেলিং নেয়াটা বিশেষভাবে জরুরী। এতে শরীর ও মন দুটোই ভাল থাকতে সাহায্য করবে। যেহেতু রাতারাতি এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় তাই তাদের পেরেন্টস কাউন্সেলিং গ্রহন করা ভীষণ দরকার। এক্ষেত্রে চাইল্ড সাইকোলজিস্ট, ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

মা বাবা বা বাড়ীর সবাইকে এসব বাচ্চাদের সব কাজেই প্রশংসা করতে হবে। আদর, উৎসাহ এবং উদ্দীপনা দিয়ে কাছে টেনে নিতে হবে, ভালবাসা দেখাতে হবে। হাসি খুশি ভাবে তার সামনে থাকতে হবে। টয়লেট ক্লিনিং শেখাতে হবে। নিজের জামা কাপড় যেন নিজেই পড়তে পারে তা শেখাতে হবে। মা-কে বুঝতে হবে যে তার সন্তান যেহেতু অন্য বাচ্চাদের মতন বয়স উপযোগী কাজ করতে পারবেনা তাই তাকে এমন ভাবে সব বিষয় এ ইন্টারভেনশন দিতে হবে যেন নিজের দরকারি কাজটুকু নিজেই চালিয়ে নিতে পারে। কখনোই তার এই বাচ্চাটাকে অন্য স্বাভাবিক বাচ্চাদের সাথে তুলনা করা যাবে না। বিধাতার আশীর্বাদ মনে করতে হবে তার এই আজীবনের জন্য জন্মানো নিস্পাপ সন্তনটিকে। সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। দেখবেন আপনার নিরলস প্রচেষ্টা এবং ইতিবাচক চিন্তার আলোকছটা ওর আচরণে প্রতিফলিত হবে। তাই নিজে উদ্বুদ্ধ হবেন, আপনার পরিবারের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবেন আপনার সন্তানের যত্ন নিতে এবং সব কাজে তাকেও উৎসাহিত করতে হবে।

প্রতিবারের মত এবারেও সারাদেশে কয়েকদিন আগেই পালিত হলো ১৪তম “বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’’। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আলোকিত হউক উদারতায়’। এই প্রেক্ষিতে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মায়েদের জন্য বলতে চাই-
“হোক না সব ধীরে
ধাপে ধাপে বেড়ে
গড়বো তোকে ধৈর্য্য ধরে
আগামীর তরে।”

লেখকঃ
শামিমা সিরাজী (সুমি)
চাইল্ড সাইকোলজিস্ট, এক্সপার্ট ইন চাইল্ডহুড স্টিমুলেশন এন্ড আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট (ইসিডি)
রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর
আইসিডিডিআর, বি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Skip to content