কামরুন নাহার সাথী, স্পেশাল এডুকেটর, ব্রাইটার লাইফ স্কুল
সম্পাদনায়ঃ নবাগত দাস, হেড অব থেরাপিউটিক ইউনিট, ফেইথ বাংলাদেশ
প্রতিটি শিশুই মায়ের কাছে তার পৃথিবী, তার শ্বাসপ্রশ্বাস। কিন্তু যখন সেই স্নেহের কেন্দ্রবিন্দুটি অটিজম নিয়ে জন্মায়, তখন মায়ের মাতৃত্বের যাত্রা হয়ে ওঠে একটু ভিন্ন, অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং অনেকটা নিঃশব্দ এক সংগ্রামের নাম। এই মায়েরা প্রতিদিন যুদ্ধ করেন—শব্দহীন ভাষায়, ক্লান্ত চোখে, আর একরাশ অদম্য আশায়। এই মা দিবসে আমরা তাদের সম্মান জানাই—যারা প্রতিনিয়ত তাদের অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সন্তানদের জন্য নিঃশব্দে লড়ে যাচ্ছেন।

অটিজম:এক আলাদা বাস্তবতা, এক নতুন পৃথিবী
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) একটি স্নায়ুবিক বিকাশজনিত অবস্থা, যা শিশুর যোগাযোগ, ভাষা, এবং আচরণে গভীর প্রভাব ফেলে। কেউ কথা বলে না, কেউ চোখে চোখ রাখে না, কেউ নির্দিষ্ট শব্দে চমকে ওঠে, আবার কেউ নিজের দুনিয়ায় গুটিয়ে থাকে। এই শিশুদের প্রতিটি আচরণ যেন এক রহস্য—যা বোঝার জন্য দরকার ধৈর্য, ভালোবাসা, আর অপরিসীম মমতা। আর এ কাজটি প্রতিদিন করে যাচ্ছেন তাঁদের মায়েরা—নীরবে, নিঃস্বার্থভাবে।
প্রতিটি মায়ের স্বপ্ন থাকে তার শিশুটি স্কুলে যাবে, হাসবে-খেলবে সহপাঠীদের সাথে। কিন্তু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর মায়েদের জন্যে এই বাস্তবতাটা পুরোপুরি ভিন্নই বলা চলে। এ শিশুদের শিক্ষাজীবন অনেক সময় শুরুই হয় না। অনেক স্কুলে নেই উপযুক্ত পরিবেশ, নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষক, কিংবা সহানুভূতিশীল সহপাঠী। অনেক সময় বাস্তবতা হচ্ছে, নিউরোটিপিক্যাল শিশুদের বাবা-মায়েরাই চান না তাদের শিশুটি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর সাথে মিশুক, তাদের সাথে খেলুক। তাই অনেক মা বাধ্য হন বাসায় থেকে হোম-স্কুলিং করাতে। কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন “অটিজম রিসোর্স সেন্টার”, “ফেইথ বাংলাদেশ – ব্রাইটার লাইফ স্কুল” বা “প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন স্কুল”—এই শিশুদের জন্য আশার আলো হয়ে ওঠে।

থেরাপি:প্রতিদিনের নীরব লড়াই
একজন মা যখন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সন্তানের জন্য থেরাপি সেন্টারের দরজায় দরজায় ঘোরেন, তখন তিনি আর কেবল মা নন—তিনি হয়ে ওঠেন একজন থেরাপিস্ট, গাইড, শিক্ষক ও সাহসী পথপ্রদর্শক। পেশাদার থেরাপিস্টদের সহায়তায় তিনিই শিখে নেন স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপির কৌশল, যাতে তার শিশু অন্যদের সঙ্গে একটু করে যোগাযোগ করতে শেখে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি চোখের দৃষ্টি, প্রতিটি প্রতিক্রিয়া—সবকিছুতেই তার নিখাদ ভালোবাসা ও চেষ্টার ছাপ থাকে।
কিন্তু শুধু কি যোগাযোগেই সীমাবদ্ধ থাকে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর চ্যালেঞ্জ? মোটেও নয়। শিশুটির দৈনন্দিন কাজ—ব্রাশ করা, খাওয়াদাওয়া, জামাকাপড় পরা কিংবা টয়লেট ব্যবহার করাও হয়ে ওঠে একেকটা যুদ্ধ। সেন্সরি প্রসেসিং-এর সমস্যা থাকায় শিশুটি হয়তো নির্দিষ্ট কাপড়ের স্পর্শ সহ্য করতে পারে না, কিংবা নির্দিষ্ট খাবারের গন্ধেই অস্থির হয়ে ওঠে। সেইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়েই একসময় মায়ের ভূমিকায় যোগ হয় আরও একটি পরিচয়—তিনি হয়ে ওঠেন সন্তানের অকুপেশনাল থেরাপিস্ট।
শিশুটি একটু বড় হলে আচরণগত সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হয় পরিবারকে। অনেক সময় শিশুর চিৎকার, আত্মঘাতী আচরণ, কিংবা হঠাৎ রেগে যাওয়া সমাজের চোখে ‘অশোভন’ হিসেবে দেখা হয়। সমাজ তখন বুঝতে চায় না যে এসব আচরণ আসলে এক ধরনের প্রকাশ—অপ্রকাশযোগ্য কষ্ট বা অতিরিক্ত উত্তেজনার ফল। অথচ মা-বাবার ওপরই পড়ে সেই গঞ্জনার ভার।
এই প্রতিদিনের নীরব যুদ্ধে মায়েরা কখনো পরিবার থেকে সাপোর্ট পান, আবার কখনো কখনো এগিয়ে যেতে হয় একাই। নিজের আদরের সন্তানের জন্যে এই মায়েরা তাদের নিজেদের সবটুকু দিয়ে সন্তানের পৃথিবীটাকে একটু করে সাজিয়ে তোলেন। অনেক মা হয়ত জানেন না, তার সন্তান আদৌ কথা বলতে শিখবে কিনা, কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে মা ঠিক বুঝে যাবেন সে ভালো আছে কি না—এটাই সেই নীরব ভালোবাসার, নীরব সংগ্রামের সৌন্দর্য।

কোনো মেডেল নেই,তবু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা
মাতৃত্ব মানেই তো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। কিন্তু অটিজম শিশুদের মায়েরা শুধু মা নন—তারা একজন থেরাপিস্ট, শিক্ষক, পরামর্শক এবং সাহসী যোদ্ধাও। তাঁদের কোনো গল্প শিরোনামে আসে না, পত্রিকার পাতায় ছাপা হয় না তাঁদের বীরত্ব। তবুও, তাঁদের সন্তানের কাছে তাঁরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা—নিঃশব্দ, অক্লান্ত, অদেখা এক সাহসের প্রতীক।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের অভিভাবকরা—কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ব্যাংকার, কেউ বা সংগ্রামী একক মা। কাজের ফাঁকে, জীবনের ক্লান্তি পেরিয়ে, তাঁরা দিনশেষে ছুটে যান থেরাপি সেন্টারে, বিশেষ শিক্ষালয়ে কিংবা চিকিৎসকের কাছে—শুধু একটি স্বপ্নের পেছনে, সন্তানকে একটু স্বাভাবিক জীবনের ছায়া দিতে।
এই যুদ্ধের নেই কোনো মেডেল, নেই অর্থনৈতিক পুরস্কার বা সামাজিক স্বীকৃতি। তবু তাঁরা লড়ছেন—নিজের স্বপ্নগুলো মাটি চাপা দিয়ে, সন্তানের হাসিটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। কখনো নিজের বিশ্রাম, আরাম বা বিনোদনের চাওয়া ভুলে গিয়ে তাঁরা হয়ে উঠেছেন সন্তানের সবচেয়ে বড় শক্তি।
এই মা দিবসে আমাদের সকলের দায়িত্ব, এই মায়েদের প্রতি সম্মান জানানো। অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা, এবং এমন নীতিমালা গড়ে তোলা যেখানে এসব শিশুদের জন্য থাকবে সমান সুযোগ। কারণ, শেখার অধিকার সব শিশুরই আছে—কেউ একটু ভিন্নভাবে শেখে, সেটাই বা দোষের কী? চাই শুধু একটু সহানুভূতি, একটু বোঝাপড়া আর সমাজের সকল স্তরে একটু সদিচ্ছা—তাহলেই বদলে যেতে পারে একটি শিশুর ভবিষ্যৎ, আর একজন মায়ের একাকী লড়াইও পরিণত হতে পারে সম্মিলিত আশার আলোকযাত্রায়।
লেখাঃ
কামরুন নাহার সাথী
ডিপেন্ডেন্ট লার্নিং
স্পেশাল এডুকেটর
ব্রাইটার লাইফ স্কুল