আমাদের প্রথম সন্তান, বিয়ের দেড় বছরের মাথায় ওর জন্ম- ৭ এপ্রিল। ওর জন্মক্ষণ নিয়ে ওর বাবার সেই আয়োজন, আগে থেকেই – সন্তানের জন্ম থেকে লাইফের প্রতিটি মুহুর্ত স্মরণীয় করে রাখবে বলে,দেখেছি পরিবারের সবার কত আনন্দ ওকে ঘিরে। আস্তে আস্তে আমাদের সন্তান বড় হয় এক মাস, দুই মাস….. চার মাসের মাথায় ও প্রথম বু .. বু বলতে থাকে, তা থেকে আ..ব্বু , আব্বু। ওর বাবার মোবাইল এর এলবামে ধীরে ধীরে জমা হতে থাকে ছেলের বিভিন্ন মুহুর্তের ভিডিও আর ছবিতে।মেটার্নিটি লিভ শেষের দিকে ,অফিসে জয়েন করার ক্ষন ঘনিয়ে আসছে। কিভাবে ওকে রেখে অফিস করবো সেই দুশ্চিন্তা মনের মধ্যে খোঁচা দিতে থাকে, একদিন আনমনে ভাতের মাড় হাতে ফেলে হাত পুড়ে ফেললাম অনেক খানি, সেটা আবার অফিস জয়েন করার ঠিক আগের দিনই। যদিও (বরফ ও পেস্ট দেওয়াতে) তেমন কিছু হয়নি। ওর ৬ মাসে বয়সে ঠান্ডা থেকে নিউমনিয়া হয়, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আল্লাহর রহমতে ৭ দিনের মাথায় সুস্থ ও হয়ে যায়। ভালই চলছিল, বাসায় ওকে নিয়ে সবার যে কি সুন্দর দিন কেটে যাচ্ছিল, আমরা একান্নবর্তী পরিবারে থাকি, তাই আমার ছেলের দাদা, দাদী, চাচা, ফুপির আদরে বড় হতে থাকে। অফিসে জয়েন করার পর, অফিসের কাজের ফাঁকেই ওকে মিস করতাম খুব। তাই ওর উপস্থিতি যেন সব সময় আমার সাথে থাকে, ওর জন্য একটা ফেসবুক পেইজ তৈরি করলাম, আর তারিখ অনুযায়ী ছবি পোস্ট করতাম, ঠিক করলাম যেদিন ওর ১৮ তম জন্মদিনে ওকে এই পেইজটি উপহার দিব। কি খুশি হবে ও ছোটবেলার প্রতিটি মুহুর্তের ছবি দেখে। ওর বাবা বলতো “কিসের এত পড়াশুনা, ওকে ওর মত হতে দেব, না হলে ও ক্রিকেটার হবে। আদর করে ওকে বলতো “তুই দুষ্ট, তুই পঁচা,আমার দুষ্ট-পঁচা”। কত শত প্ল্যান বাবা মা- র নিজেদের করে, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার প্ল্যান তো বিশাল কিছু, তাঁর সাথে কি আমরা পারি?
আমাদের দুষ্ট-পঁচা এক বছরে পা দিল। বাসায় বিশাল আয়োজন, এলবামের পাতায় সেই ছবিগুলো আজও সুখ ছড়ায়। তার ঠিক একমাস পর আমি আবার কনসিভ করলাম। আমার সেই কি কান্না, কিভাবে অফিস, সংসার, বাচ্চা সামলাবো এই অবস্থায়। তখনও কি জানতাম সৃষ্টিকর্তার প্ল্যান অনেক বেশি আমাদের চেয়ে? উনি যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।
আমাদের সন্তান তুলনামূলক ভাবে খুব তাড়াতাড়ি ABC শিখে ফেলে, বিভিন্ন Rhymes অভিনয় করে দেখাতো বলার সাথে সাথে ( অফিসে যাবার সময় ও কাঁদতো বলে টিভিতে Youtube দিয়ে যেতাম)। আমরা তো অনেক খুশি। ওর দাদাভাই প্রায় বলতেন “ওকে ডাকলে শোনে না”। আমরা তেমন গুরুত্ব দিতাম না, ওর বাবা বলতো,” না শুনলে ও বলতে পারে কিভাবে? ওতো শুনে শিখে তারপর আমাদের শোনাতে পারছে”।
ধীরে ধীরে দ্বিতীয় বাচ্চার জন্মক্ষন এল, আমাকে OT তে নিয়ে যাওয়া হলো, আমার দুষ্ট-পঁচা নাকি OT Complex দেখেই পড়তে পেরেছে, O . . . T . . . C. . ওর নানু তো অবাক হয়ে গিয়েছিল ওর পড়া দেখে, ওর মামা (আমার ছোট ভাই) কে বলেছিল, ওকে সরিয়ে নিতে যেন কারো নজর না লেগে যায়। ওর বাবা ঐ সময় টাতে আমার হাসপাতালে থাকার দিনগুলোত ওকে সময় দিত হাসপাতাল থেকে গিয়ে, আর ওতো সব সময় ওর দাদা দাদীর সঙ্গেও থাকতে খুব পছন্দ করে। দ্বিতীয় বার মেটার্নিটি লিভে থাকার সময় ওর বিহেভিয়ার চেন্জ গুলো চোখে পড়ে।ওকে ফাস্ট হেয়ারিং টেস্ট করাই, সেখান থেকে রিপোর্ট এল হিয়ারিং প্রবলেম নেই, ঠিকই আছে, তবে স্পীচ থেরাপী দিতে বলে। তখনও “অটিজম” নামক কঠিন শব্দের সাথে পরিচিত হই নি। যাই হোক, শুরু করি থেরাপী, পাশাপাশি ওর বাবার অফিসের চাইল্ড স্পেশালিস্ট “জেনা আপা”র সাথে কথা হয়, উনার রেফারেন্সে একজন সাইকোলজিস্টের সাথে দেখা করি, উনার কাছেই সর্বপ্রথম “অটিজম” শব্দের সাথে পরিচিত হই, কিন্তু শব্দের মাঝেই সীমাবদ্ধ এর ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আপা তেমন ডিটেইলস বলেন নি, হয়তো নতুন পথিক হিসেবে প্রথমেই মন ভাঙ্গতে চাননি।
আমি দুই বাচ্চা, সংসার, অফিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই। ওর বাবা ইন্টারনেট ঘেটে ঘেটে ঠিকই সব ইনফর্মেশন নিতে থাকে, শুরু হয় তার নতুন যুদ্ধ। এই ডাক্তার, ঐ ডাক্তার, এক দিন এই সাইকোলজিস্ট, তো আরেকদিন ঐ সাইকোলজিস্ট, এমন কি দেশের বাইরেও কোথায় গেলে শুনবে যে “আমাদের দুষ্ট-পঁচা অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশু না”।প্রথমে সে আমাকে কিছুই বলতো না। নিয়ম করে থেরাপী দেয়া আর বাসায় কাজ করতাম, অফিস থেকে ৪৫ দিন ছুটিও নিলাম, আমার বিশ্বাস ছিল ঐ কয়েকদিন ওকে ঠিক ভাবে সময় দিলে ও ঠিক হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে ওর বাবা আমাকে সব শেয়ার করতে থাকে, বরাবরের মত চুপচাপ আমি খুব আপসেট হয়ে যাই ভিতরে ভিতরে, কি যেন এক শুন্যতা পেয়ে বসে আমাকে। বাচ্চা অথবা এডাল্ট কাউকে দেখলেই মনে হতো “ওর তো অটিজম না, তবে আমার বাচ্চার কেন?” এই প্রশ্ন মনে হয় পৃথিবীর সকল স্পেশাল বাচ্চার বাবা মায়ের, সবাই এখনও হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায়।
এক সময় চাকরী ছেড়ে দেই ,ওকে সম্পুর্ণ সময় দিব বলে, শুরু হয় আমাদের সময়ের সাথে ছুটে চলা- সকালে স্কুল, বিকেলে থেরাপী, বাসায় ওর সঙ্গে কাজ আর সপ্তাহ শেষে ওকে সাঁতার শেখাতে নিয়ে যাওয়া–এ এক অন্যরকম যুদ্ধ। পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর যুদ্ধ। ছোট থেকেই যেন ও এডজাস্ট করতে পারে তাই পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়ানো, কষ্ট হলেও CNG বা CAR ব্যবহার করতাম না। ছোট থেকেই ওকে নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটাতাম। মাঝে মাঝে অনেক আপসেট হয়ে যেতাম, পরক্ষনেই মনে হতো “আমি তো একা নই, আমার মতো আরো অনেকেই হাঁটছেন এই পথে, ওরা যদি পারে তাহলে আমি কেন পারবো না। আমাকে পারতেই হবে”। ওর বাবা যেখানেই নতুন কিছু পেত অটিজম সম্পর্কে সেটা ট্রেনিং হোক অথবা থেরাপী, সেটার সঙ্গেই আমাকে যুক্ত করতো, নিজে ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের রাখতো, যা আমাকে এই পথে চলতে সাহায্য করছে। সহজ করেছে আমাদের দুষ্ট-প্ঁচার জীবন যুদ্ধে সহযোগী হতে। আমাদের সন্তান কি হবে জানি না, কিন্তু এখন থেকেই ও হয়েছে উঠচ্ছে এক কঠিন যোদ্ধা। জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার যোদ্ধা, ও আমাকে অনেক শিখিয়েছে, ওর কাছ থেকে শিখেছি জীবনে হেরে যেতে নেই, সব সময় ঘুরে দাড়াতে হয় নতুন ভোরের অপেক্ষায়।
সবসময় ভাল থাকিস বাবা, ভোরের আলো ফুটলে বলে, আমরা চারজন মিলে হাঁটবো সেই আলোয়। ইনশাল্লাহ ।
দোয়া করি আপনাদের জীবনে ভোরের ফিরে আসুক যে আলোয় ভরে থাকবে আপনাদের সকলের জীবন….. ইনশাআল্লা। অনেক অনেক শুভ কামনা।
ধন্যবাদ ।দোয়া করবেন ভাই।
দুষ্টু-পচার মায়ের গল্পটা পড়ে আমি ২০ বছর আগে ফিরে গেছি। আমার ছেলেকে নিয়ে এই যুদ্ধ করতে করতে আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যুদ্ধ ছাড়া জিবনকেই এখন অসাভাবিক লাগে। আমাদের হিসাব আর সৃষ্টিকর্তার হিসাব এর মাঝে অনেক তফাৎ। যিনি জীবন দিয়েছেন তিনিই আবার এই জীবনের হিসাব নিকাশ চাইবেন।আমার ছেলে আমার জীবনের হিসাবের অংশ। বিশেষ মা-বাবাকে আল্লাহতালা বিশেষ ভাবে ট্রিট করবেন এটা আমার দৃঢ় বিশ্যাস। এরকম নিস্পাপ আর বিশেষ শিশু আছে বলেই হয়ত আমার মানসিক শক্তিটা অন্য আর দশটা মায়ের চেয়ে বেশি, সহজে ভেংগে পড়ি না। আমাদের লাইফ সটাইল অন্য আর ১০টা পরিবারের মত না। তোমাদের ভাইয়া তো আমার অনেক আগেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। সবসময় ছায়া সংগি হয়ে আছে।
তোমরা টের পাবে যে ছেলের জন্য জীবনের কত চ্যালেঞ্জ মুকাবিলা করতে শিখে যাবে। কত বেশি দায়িত্ব নেয়া শিখবে আর তোমরা পেরেও যাবে।ধৈরয্য রাখ। রফিক বাবা এবং মানুষ হিসাবে অসাধারন। এই বোঝাপোড়া টা আমাদের মত বিশেষ পরিবারের জন্য খুবী দরকার। ভাল থেক।
শারমিন আপা
দোয়া করবেন আপা যতদিন বাঁচি নিজের দ্বায়িত্বটা ভালভাবে পালন করতে পারি।আপনারাই আমাদের অনুপ্রেরনা যোগান সবসময়।