আমরা এখন যে দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি,এই পরিস্থিতি নিয়ে যদি শুধু নেতিবাচক চিন্তা করি, তাহলে আমাদের মধ্যে চরম হতাশার জন্ম হবে। আমাদের ইমিউন সিষ্টেম অথবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে। সৃষ্টি হবে নানাবিধ মানসিক ও শারিরীক দৈন্যতা। তাই প্রথমেই নিজেকে ও পরিবারের সবাইকে সুরক্ষিত রাখার প্রস্তুতি নিতে হবে।
গর্ভ থেকে প্রথম ৫ বছরের মধ্যে শিশুদের বিকাশ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটার প্রভাব পড়বে তারা কিভাবে স্কুলে ভালো করবে, কিভাবে তারা ভালো আচরণ করবে এবং যা তার প্রাপ্ত বয়সে সাফল্য নিয়ে আসবে। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ব্রেইনের যে সাইজ থাকে ঠিক জন্মের সময় একটি শিশু তার অর্ধেক সাইজ নিয়ে পৃথিবীতে জন্মায়। ১৮ মাস বয়সে চারের তিন ভাগ পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে। চার বছর বয়সে শতকরা ৯০% বিকাশ সম্পন্ন হয়ে যায় এবং বাকি মাত্র ১০% তার পারিপাশির্^ক পরিবেশ থেকে সারাজীবন ধরে সে শিখতে থাকে। এজন্যই এই সময়কালটা আপনার শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে যত্নশীল হওয়াটা ভীষনভাবে জরুরী।
গর্ভকালীন সময়ে মা ও শিশুর যত্নঃ
গর্ভকালীন সময় থেকে একটি শিশুর বুদ্ধি ও শারিরীক বৃদ্ধির বিকাশ শুরু হয়ে যায়, করোনার এই দিনগুলোতে গর্ভবতী মায়েদের সুরক্ষার জন্য কয়েকটি নিয়ম মেনে চলতে হবে—-
• আতঙ্কিত না হয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থাশীল হতে হবে।
• পুষ্টিকর খাবার ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
• শুধুমাত্র ফেসবুকে অভ্যস্ত না হয়ে বইয়ের পাতায় দৃষ্টি রাখতে হবে যেমন – গল্পের বই,উপন্যাস,ধর্মীয় বই পড়ার অভ্যাস করতে হবে। নিজেকে বোঝাতে হবে এ সংকটময় দিন চিরদিন থাকবেনা, স্বাভাবিক নিয়মেই পৃথিবী একসময় শান্ত হবে।
• অবসর সময় বাড়িতে পড়ে থাকা রঙিন সূতি কাপড়, সূতা বা অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে আপনার শিশুটির জন্য সুন্দর সুন্দর খেলনা,কাঁথা ও জামা কাপড় তৈরী করতে পারেন। এ সময়ে আপনার সুন্দর সুন্দর কাজগুলো, চিন্তা ভাবনাগুলো আপনার সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশে প্রতিফলিত হবে। আপনি নিজেকে উপহার দিতে পারবেন সুস্থ,সুন্দর একটি সন্তান।
শিশুর বিকাশে খেলার প্রয়োজনীয়তাঃ
শিশুর সব ধরনের বিকাশের জন্য খেলাধূলা করা অতি জরুরী। আপনি লক্ষ্য করলেই দেখবেন একটি শিশু খেলার মাধ্যমে বেড়ে উঠে। খেলাধূলা করাই তার একমাত্র কাজ। বিকাশ বলতে আমরা শারিরীক বৃদ্ধি, বুদ্ধি,ভাবের আদান প্রদান (ভাষাগত বিকাশ), আবেগের প্রকাশ ও সমাজে মেলামেশাকে বুঝি — খেলার সময় সে খুব খুশি থাকে, খুব আনন্দ পায়। ’’ শিশু বিকাশ নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা করেছেন আইসিডিডিআর,বি এর Scientists Dr. Jena Hamadani & Dr. Fahmida Tofail. ফলাফলগুলোতে দেখা গেছে বয়স অনুযাযী মনোসামাজিক উদ্দীপনা প্রদানের বা খেলাধূলার প্রভাব শিশুর মানসিক ও শারিরীক বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাচ্চাকে তার বয়স অনুযায়ী খেলনা দিন। যেমন- • জন্মের পর থেকে ৪ মাস পর্যন্ত বাচ্চার সাথে নানা রকম রঙিন নরম খেলনা দিয়ে খেলা করুন এবং হাসিমুখে বার বার নানা ধরনের কথা বলুন।• ৭ মাসের বাচ্চার চোখের সামনে খেলনা লুকিয়ে রেখে তাকে তা বের করে আনতে দিন। • ১৮ মাস বয়সে ছোট নরম রঙিন বল হাতে দিয়ে ছুঁড়তে দিন অথবা গুটি দিয়ে গাছ বানাতে দিন।• ২১-৪২ মাস বয়সে কোন জিনিস এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়া, একটার উপর আরেকটা সাজানো, ফেলে দেওয়া, এগুলোর পাজল বা ধাঁধাঁর খেলা,ছবি মেলানো, লেবেলিং করা (যেমন- বিভিন্ন ধরনের খেলনা আলাদা আলাদা ভাবে গুছিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা। এসব খেলার মাধ্যমে বাচ্চারা সমস্যা সমাধান করতে শেখে ও তাদের স্মৃতি শক্তির বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে,অবসর সময়ে সাথে কথা বলুন,ছড়া, খেলা শেখান, হাসুন। এতে বাচ্চার ভাষাগত বিকাশ তরান্বিত হয়ে বয়সের সাথে সাথে সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে উঠবে। রঙিন পেন্সিল ও খাতা দিয়ে বাচ্চাকে বয়স অনুযায়ী আঁকা আঁকি এবং ছবি আঁকতে উৎসাহিত করুন। ছোট ছোট গুটি দিয়ে কিছু বানাতে দিন। এতে করে সূক্ষপেশীগুলোর সঞ্চালন ( Fine motor development )হয়। এই লক ডাউনের সময়ে বাড়ির বাইরে যেহেতু খেলতে যাওয়া সম্ভব নয়, সেজন্য বাড়িতেই নরম কাপড়ের বল দিয়ে ছুঁড়াছুঁড়ি করে খেলার সুযোগ করে দিন। এতে করে আপনার সন্তানের শারিরীক বিকাশ বাঁধাগ্রস্থ হবেনা।
বয়স অনুযায়ী আরো কিছু খেলাঃ
পালা করে খেলা, অনুকরণ করে খেলা এবং বাড়িতে দুটি সন্তান বা তার অধিক থাকলে দল তৈরী করে নিয়ম মেনে খেলাগুলো খেলতে দিন। পালা করে টিম লিডারও বানিয়ে দিন। অনেক সময় একটি খেলনা নিয়ে দুজনেই জেদ ধরে, এই রকম পরিস্থিতিতে দুজনকেই সময় নির্ধারন করে দিন এবং পালা করে খেলতে উৎসাহিত করুন। নতুন করে বিভিন্ন উপায়ে সমস্যা সমাধান করা যায়, এ ধরনের খেলাধূলা খেলতে আপনার সন্তানকে উৎসাহিত করুন।
আপনার সন্তানটির মানসিক ও শারিরীক বিকাশ,ভাষাগত বিকাশ এবং ইতিবাচক ব্যাক্তিত্ব (Personality attributes),সমস্যা সমাধানে পারদর্শিতা (Analytical Ability), সময়মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Leadership skill) অন্যের সাথে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে পথ চলতে পারে,নিজস্ব সত্বা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। এগুলোর প্রতিটি বিষয়ে পদক্ষেপ আপনাকেই নিতে হবে। লক্ষ্য করবেন,বাচ্চারা অনুকরণ প্রিয়। বড়দের যা করতে দেখে তাই তারা রপ্ত করে নেয় খুব সহজেই। তাদের স্মরণশক্তি খুব প্রবল। এই অনুকরণপ্রিয় বিষয়গুলো তারখেলার মাধ্যমে ফুটে উঠে। আপনার সন্তানের সাথে ফান বা মজা করুন। কিন্তু এই মজাগুলো যেন নিছক বা ভিত্তিহীন না হয়। প্রতিটি ফান বা মজার পেছনে একেকটি শিক্ষনীয় ম্যাসেজ ছুঁড়ে দিন। একদিন এই অনুশীলন তাকে শেখাবে কিভাবে অনেক কঠিন বিষয়গুলোতে সহজ করে ম্যানেজ করতে হয়।
গৃহবন্দী এই দিনগুলোতে বাড়ির পরিবেশ আনন্দময় করে তুলুন। বিষন্নতা,আতঙ্ক এগুলোকে বর্জন করুন। কোনভাবেই যেন এ বন্দী জীবন আপনার সন্তানের মানসিক ও শারিরীক বিকাশকে বাঁধাগ্রস্থ না করে। খেলনা ছাড়াও আপনার সন্তানের সাথে অনেক ভাবে আপনি খেলতে পারেন। যেমন-আমি যা দেখি তুমি তা দেখ, হাত তালি, লুকোচুরি এরকম নানা ধরনের খেলা তার বয়সের সাথে মিলিয়ে খেলতে পারেন। এছাড়াও ছড়া বলা, গল্প বলা তাদেরকে সাথে নিয়ে বাচ্চাদের উপযোগী সিনেমা দেখা। এসব করে তাদের সাথে সময় কাটাতে পারেন। এতে করে নানারকম গ্যাজেট (যেমন-মোবাইল,স্মার্ট ফোন, ট্যাব) এর আসক্তি থেকে তারা সরে আসবে। আর হ্যাঁ,সন্তানের উপর কিছু চাপিয়ে দিবেননা। সরাসরি না কথাটি বলবেননা। জেদ করলে তাকে বুঝিয়ে দিন। তার সামনে অন্যের সমালোচনা করবেন না। তাকে কারো সাথে তুলনা করবেন না। আপনার নিজের ইচ্ছাটিকে ওর উপর চাপিয়ে দেবেন না। তাকে বলবেন না, তোমাকে অমুক হতে হবে, সমুখ হতে হবে। তাকে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে উঠতে দিন।
ফেলনা জিনিস দিয়ে খেলনা বানাতে নিজেকে উৎসাহিত করুনঃ
বৈশ্বিক এ মহামারীতে সৃষ্টি হচ্ছে অর্থনৈতীক মন্দা। আমাদের সামর্থ্য যেমনই হোক না কেন, আমরা সবাই মিলে শ্রেণী বৈষম্য কাটিয়ে উঠতে একে অপরকে সাহায্য করি। যেমন ধরুন- ঘরে থাকা অপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে খেলনা বানিয়ে আপনার সন্তানকে খেলতে অনুপ্রানিত করুন। অবসর সময়ে আপনি যা করতে পারেন-• ঘরে অনেক বাড়তি টুকরা কাপড়, তুলা, নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় প্লাষ্টিক বোতল, কৌটা আরও অনেক জিনিসপত্র দিয়ে আপনার কল্পনাগুলো কাজে লাগিয়ে বানিয়ে ফেলতে পারেন আকর্ষনীয় সব খেলনা। যেমন- রঙিন নরম বল, পুতুল, পুতুলের ঘর-বাড়ি।• কাগজ কেটে নানারকম আকৃতি দিয়ে শক্ত কাগজের উপর আঠা লাগিয়ে তৈরী করতে পারেন নানারকম ধাঁধাঁর খেলা। যা আপনার সন্তানের চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমস্যা সমাধান করতে শিখাবে।• এছাড়া আমাদের দেশীয় ফুল,পাখি, ঘর, নৌকা, ঢেঁকি, নানারকম খেলনা বানিয়ে দেশীয় জিনিস পত্রের সাথে আপনার সন্তানকে পরিচিত করাতে পারেন।তবে হ্যাঁ, খেলনাগুলো বানাতে হবে আপনার সন্তানের বয়স উপযোগী। যাতে করে সে খেলনাগুলি দিয়ে খেলার সময় সহজেই আনন্দের সাথে খেলতে পারে।
আপনার সন্তানের সুরক্ষায় কোয়লিটি টাইম নিশ্চিত করুনঃ
করোনার প্রাদুর্ভাবের এই দিনগুলোতে আমরা আমাদের ভীষন ব্যস্ত সময় থেকে অনেকটা দুরে সরে আছি। তাই আপনার ব্যাস্তজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের বেশীর ভাগটাই আপনার সন্তানকে দিতে পারেন। যাকে বলে কোয়িলিটি টাইম।
প্রতিটি শিশু সৃষ্টিশীল প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। আপনার সন্তানের সকল কর্মকান্ড গুলোকে পুঙ্খানুপূঙ্খ ভাবে পর্যবেক্ষন করার এইতো সুযোগ। লক্ষ্য করলেই দেখবেন, সারাদিন ধরে কত সৃষ্টিমূলক কাজ সে করতে পারে যা আপনার ভাবনাতেই নেই। যেমন- নিজে নিজেই নানা ধরনের ছবি এঁকে, গাড়ি খেলনা বানিয়ে এনে আপনাকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। কতরকম গল্প, ছড়া বানিয়ে আপনাকে শোনাচ্ছে। একটু চিন্তা করলেই দেখবেন, সবকিছুর পেছনেই অর্থবহ কারন আছে।
এই সৃষ্টিশীল কাজগুলোকে আবিস্কার করে নিজস্ব সত্ত্বার গুনাগুনগুলো বাছাই করে তার এই প্রতিভাগুলোর প্রতিযত্নশীল হওয়াটা অভিভাবক হিসেবে আপনার গুরু দায়িত্ব। দেখবেন, এই সৃষ্টিশীল প্রতিভাগুলোকে লালন করতে করতে একদিন সে সমাজে সৃষ্টিশীল ভূমিকা পালন করছে।
করোনার এই প্রাদুর্ভাব আমাদের সমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা সবাই কম-বেশী যে যার বাড়িতে বসে দিন কাটাচ্ছি। এই সময়গুলিতে আপনার বাচ্চাদের শেখার জন্য একটা সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে পারেন। দৈনন্দিন বাচ্চার যত্নেরকাজগুলো যেমন- খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানোইত্যাদি এমনকি মায়ের গৃহস্থালীর কাজগুলোর সময়ও বাচ্চাদের সাথে কথা বলার এবং খেলার মাধ্যমে নতুন ধরনের বিকাশমূলক দক্ষতাগুলো অর্জনে সহায়তা করতে পারেন। যেমন- হাত ধোয়ার বিষয়টি গল্পের ও খেলার ছলে আপনার সন্তানকে শেখাতে পারেন। পাশাপাশি শেখাতে পারেন টয়লেট ট্রেনিং ও অন্যান্য পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার নিয়মাবলী। এ সময় লক্ষ্য করতে হবে বেশী বেশী হাত ধোয়া কোন মানসিক সমস্যার সৃষ্টি না হয়। যেমন-শুচিবায়ুতা (Obsessive Compulsive disorder)
আপনার সন্তানের প্রতিটি কাজে তাকে প্রশংসা করতে হবে। দেখা যাবে কোন কাজ সে পুরোটা শেষ করতে চায়না, জেদ ধরে, তারপরও সে যতটুকু চেষ্টা করেছে ততটুকুর জন্য তাকে প্রশংসা করুন। প্রশংসা আপনার শিশুটির মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরী করবে। আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
দীর্ঘ সময়কাল ব্যাপী স্কুল ছুটি এবং খেলার সাথীদের সাথে মেলামেশা বন্ধ। স্বাভাবিক কারনেই আপনার সন্তান অহেতুক কারনে দুষ্টামী বেশী বেশী করতে পারে। এ অবস্থায় তাকে শাসন করতে হবে আদর দিয়ে। আপনার সন্তান যদি একটু বেশী জেদ করে যা আপনার মনে বিরক্তির সৃষ্টি করে তাহলে তাকে জড়িয়ে ধরে বলুন, বাবা তোমার কি অনেক চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে,আচ্ছা করো, যতক্ষন তোমার ইচ্ছে করো। ধৈর্য্য ধরে একটু সহ্য করুন। ধীরে ধীরে দেখবেন ও আর এমনটি করবেনা। আপনার সন্তানের বয়স ও ব্যক্তিত্বের ধরন অনুযায়ী তাকে আদর দিয়ে শাসন করুন। পরিশেষে বলতে চাই———-
আদর দিয়ে করলে শাসন
বুঝবে শিশু শুনবে বারণ।