করোনা সময়ে খোলা চিঠি

Spread the love

“দুষ্টু করোনা” – করোনাকে আমার সাড়ে চার বছরের  মেয়ের দেওয়া বিশেষণ। দুষ্ট করোনার  কারণে বন্দি দশায় আমাদের জীবন যত না অতিষ্ঠ , আমরা যত না ভীতসন্ত্রস্ত ; ওরা  ততটা না হলেও ওদের মনের উপর ঘরে আটকে থাকার মানসিক ভাবে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া  তৈরি হচ্ছে আর ওদের যত না ক্ষতি হচ্ছে আমাদের মনে হয় তার ধারে কাছেও হচ্ছে না। 

নিজের কথা

১ মাস হয়ে গেলো বাসা থেকে বেড়িয়েছি গুনে গুনে ৪ দিন বড় বাজারের জন্য, আর বড় জোর ৩ দিন নিচের দোকানে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার , সারাদিন কম্পিউটারে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করার পর আসলে নিজেকে মানসিক আর শারীরিক ভাবে ফিট রাখাই একটা চ্যালেঞ্জ। মরার উপর খরার  ঘাঁ  হিসাবে ২ মাসের মধ্যে যে চাকরিটা চলে যাবে না তাও  কিন্তু বাজি রেখে বলতে পারি না । কিন্তু ১ মাস পরে বুঝতে পারছি যে আমাকে কিছুটা হলেও ডিপ্রেশন আস্তে আস্তে ধরছে। ভারত যাবার কথা ছিল মেয়েকে নিয়ে এই এপ্রিলে, খুব দরকার ছিল ওর টেস্ট করানো আর ওষুধগুলি রিভাইস করা  কারণ ১ বছর যাবৎ ৬ টা ওষুধ চলছে ওর।  কিন্তু জানিনা এই বছরে আর যেতে পারবো  কিনা। অন লাইনে কনসাল্ট করেও লাভ হবে না, কারণ মেয়েকে টেস্ট করানো আর সামনে থেকে  দেখেই ডাক্তাররা ডিসিশন নিতে চান।   ইদানিং মেয়েটা খুব চিৎকার করে… ছোট কোনো ব্যাপারে  কিছু যদি এদিক ওদিক হয়ে যায় বা যদি না হটাৎ করে কেউ সামনে না  থাকে তখন খুব উত্তেজিত হয়ে যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাচ্চাদের জিদের চিৎকার সহ্য করতে পারি না, নিজের উপরে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছি বিশেষ করে যখন অফিসের কাজের সময় ঘটনা ঘটে। আমার স্ত্রী, মা আর বাবা আমার কাজ সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত তাই তারা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করে আমার অফিস টাইমে সাপোর্ট দিতে। কিন্তু আমার জবের নেচার এমন যে মাঝে মাঝে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয় ভেঙে ভেঙে। মেয়েকে বকেছি  কয়েকবার  এর মধ্যে কিন্তু বুঝতে পারছি এটাও যে বাবাকে  চোখের সামনে দেখলে বাচ্চা তো স্বাভাবিক ভাবেই কাছে আসবে আর তার বিহেবিয়ারাল ইস্যু তো খুব স্বাভাবিক অতএব ইটা কে কন্ট্রোল করতে হলে ওকে বার বার বুঝানোর চেষ্টা করা ছাড়া কিছুর করার নাই।  কিন্তু দিন শেষে এটাও সত্যি যে এই সময়ে আমার মনের উপর যে চাপ তা পড়ছে, ওদের মনে উপর হয়তো পড়ছে চাপটা আরও বেশি।  তাই স্বভাবগত ভাবে যে সমস্যা ওর তৈরী হচ্ছে তার জন্য  এই পারিপার্শ্বিক অবস্থাও দায়ী পরোক্ষভাবে বা প্রতক্ষ্যভাবে।   তবে একটু বলে রাখি আমার মেয়ের আসল সমস্যা  হচ্ছে বিহেবিয়ারাল ইস্যু আর হাইপেরনেস। আমি জানিনা ফেইথে বা প্রয়াস এর মতো ইনস্টিটিউটে আমি যেসব আরও সেনসিটিভ স্পেশাল   বাচ্চাদেরকে দেখেছি তারা কিভাবে খাপ খাওয়াবে এই অবস্থার সাথে, সন্দেহাতীত ভাবে খুবই কষ্টদায়ক আর দুঃসাধ্য সময় পার করছে তারা, কম বেশি সবাই করছি আমাদের মতো মা বাবা রা।   

কি করছি / কি করা যেতে পারে? 

প্লেন এ যখন অক্সিজেন মাস্ক বেরিয়ে আসে আগে বলা হয় নিজেকে পড়তে তারপর বাচ্চাকে।  আসলে  এর মধ্যে  নিজেকে চাঙ্গা রাখা খুব দরকার, কারণ এটা  বুঝতে পারছি নিজে মুষড়ে পড়লে বাচ্চারা আর ও মুষড়ে পড়বে । তাই আমার মনে  হয় বিশেষ করে যেসব বাবা ওয়ার্ক ফ্রম হোম এ আছেন, একটু রুটিন করে কাজ এর গন্ডি থেকে বেরিয়ে আপনার বাচ্চাকে একটু সময় দেওয়ার চেষ্টা করুন। কারণ ওদের নতুন কিছু দরকার  এই সময়টায় টিকে থাকার জন্য।  অবশ্য এই ব্যাপারটা স্বাভাবিক বাচ্চাদের জন্যও প্রযোজ্য আসলে। আমার মনে হয় আমাদের প্রত্যেকটা বাচ্চা যেহেতু স্বতন্ত্র তাই বাবা মা এর এনগেজমেন্ট ও স্বতন্ত্র।  নিজেরাই চিন্তা করুন কিভাবে নিজেকে নতুন ভাবে এনগেজ  করবেন , সেই সাথে বাচ্চাকেও।  এমনও হতে পারে রান্না করার চেষ্টা  করুন যদি না করে থাকেন, আর বাচ্ছার জন্য কিছু বানানর চেষ্টা করুন। বাচ্চা আপনার সাথে রান্না ঘরে না থাকতে পারলেও নতুন খাওয়াটা একটা বাড়তি তৃপ্তি দেবে আপনাদের দুজনকেই। একটু চিন্তা করে দেখুন কিভাবে নতুন করে সময়  কাটানো যায়? পারলে  একটু রুটিন করে ফেলুন। 

প্রসঙ্গ : বাইরে যাওয়া

করোনা শেষ হলে কোন জায়গায় যেতে চাও?  “স্কুল তারপর ফেইথ” – মেয়ের উত্তর আগে এই দুই জায়গায় যাবো তারপর খেলার জায়গায় (কিড জোনে)।   এই অবস্থায় আমরা কেউ বের হতে পারছি না।  আর এর প্রভাবটা বাচ্চাদের  উপর মারাত্মক,বিশেষ করে আমার মেয়ের মতো যারা প্রত্যেক দিন বের হতে অভস্থ্য। বাইরের জগত তা তার কাছে খুব চেনা হলেও তার বর্তমান অস্বাভাবিকতা কে ওদের মপক্ষেই মেনে নেওয়া  কষ্টকর।  মেয়ে হটাৎ বলে ওঠে আজ স্কুল খোলা, ওরা  বাইরে খেলছে,  টিভি তে হয় পুরানো কোনো ভিডিও দেখে বলে ওঠা ওই যে খেলার জায়গায় খুলেছে। মনে রাখা দরকার আমাদের প্রতেক্যের একটু বাইরের এল বাতাস দরকার প্রতিদিন।

কি করছি আমরা?

আমরা ঠিক করেছি সপ্তাহে ২ দিন অন্তত ছাদে নিয়ে যাবো মেয়েকে।  যাদের সেই সুযোগটা নেই তারা একটু চেষ্টা করে দেখুন কোনো নিরাপদ খোলা জায়গায়  একটু সুযোগ করে নিতে পারেন কিনা। আর বাচ্চা কে নিয়ে একটু রাস্তা দেখানো সেই সাথে বর্তমান পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ে ব্রিফ করা।  সে বুঝুক আর না বুঝুক রাস্তার অবস্থার পার্থক্যটা চোখের সামনে  নিয়ে আসুন , এতে তার চিন্তা করার সামর্থ্যও বাড়বে। আর অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ  মতো তার প্রিয় বন্ধুর সাথে ভিডিও চ্যাট  করানো যেতে পারে কিনা সেই বিষয়ে কথা বলে দেখতে পারেন। এতে পারস্পরিক ভাবে একই বয়সের অনন্য কাউকে দেখে তার হয়তো এক ধরণের আন্ডারস্ট্যান্ডিং জন্মাতে পারে। তবে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন।  আর আমার মনে হয় অতীতের  কোনো    ভ্রমণ স্মৃতি রোমন্থন করা এবং এখন সেখানে কি হচ্ছে ডেটা বলে তার ইমাজিনেশন নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। ইমাজিনারি প্লেতে আপনি নিজেই পারেন প্লট তৈরী করতে আর আপনার বাচ্চাকে ইনভল্ভ করতে। এটাতো সত্যি সবাই মাইল খেলার সুযোগটা কিন্তু হয় হামেশা আমরা  এভাবে পাই না। 

প্রসঙ্গ: প্রতিদিনের রুটিন

এই ব্যাপারটা  বাঙালির জন্য আসলে একটু কঠিন। কারণ স্বাভাবিকতার ব্যতয় হলেই আমরা আমাদের প্রতিদিনের রুটিনকে গলা চিপে মেরে ফেলতে ওস্তাদ। আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রেই  এটা প্রযোজ্য, ছেলে মেয়েদের ক্ষেত্রে একটু হবে না কেন? মেয়ের  কিছু কিছু এক্টিভিটির  টাইম টেবিল  দেখছি অলরেডি  উল্টো পাল্টা হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই  যেহেতু অনেক কিছু জো  করার নেই, ছেলে মেয়েরা কিন্তু তাদের মতো করে সময় কাটাতে চাইবে।

কি করা যেতে পারে?

এটা নিয়ে সত্যি বলতে চিন্তার অবকাশ  আছে  আমারও। কিন্তু একটু চিন্তা করে দেখুন ওদের প্রত্যেকদিনের জীবনটাকে ঘরের মধ্যে কতটা  সাজানো যেতে পারে। যেমন স্কুলের সময়টায় বা হোম ওয়ার্ক করার সময়টায়  একটু হোম স্কুলিং করা।  আবার যে সময় তা ফেইথে  এ যেতেন ওই সময়টায় ফেইথের যে এক্টিভিটিগুলো বাসায় করানো যায় সেগুলো করানো। জানি সব কিছু করানো সম্ভব নয়। কিন্তু এই অবস্থায় খড়কুটো ধরে ভেসে থাকা  ছাড়া কি কিছু করার আছে? আমি নিজে  একটু ব্যায়াম  করার চেষ্টা করি আর মেয়েকেও প্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে সময় মতো ঘুমের খাওয়াদাওয়াটা আমার মতে  অনিবার্য্যভাবে মেনে চলা উচিত। এই প্রসঙ্গে খুব সুন্দর একটা ব্লগ দেখলাম এখানে, ভাবছি এটাও ভালো করে ফলো করার চেষ্টা করতে হবে, কারণ এভাবে কয়দিন কাটাতে হবে তার কোনো হিসেবে করতে পারছি  না।

শেষে, 

জানিনা এই অবস্থার শেষ কোথায়, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে অনেক বেশি অনিশ্চয়তা।  তারপর ও এটাই জীবন। মেয়ের ক্ষতি যে কিছু হচ্ছে না তা বলা যায় না, কারণ স্পেশাল বাচ্চাদের এই বয়সটায় এভাবে অবরুদ্ধভাবে সময় চলে যাওয়াটা  মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে একটা অপূরণীয় শুন্যস্থান তৈরী করছে। তাই চলুন নিজেরাই নিজেদের মতো থেরাপিস্টদের সাথে টেলি কাউন্সলিইং করে যথাসাধ্য চেষ্টা করি।

পরিশেষে একটা বিষয় নিয়ে ফেইথের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, এই অবস্থায় ভিডিও কনফারেন্সিঙের মাধ্যমে এই বাচ্চাদের জন্য যদি কোনোরকম এইডভাইসিং বা কাউন্সিলিং কাজে আসে তাহলে আপনারা আশা করি সেদিকটা নিয়ে চিন্তা করবেন। ফেইথকে আমি যেভাবে দেখছি তাতে আমার বিশ্বাস তাদের উদ্ভাবনী শক্তিতে এই অবস্থার মধ্যেও আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য  তারা  চিন্তা করছেন।  আর থেরাপিস্টরা তো আছেন, কিছু না পারলে ওনাদের সাথে কথা বলে হয়ত মা বাবাদের মন একটু হালকা হবে। ভালো লেগেছে যখন মেয়ে কেমন আছে খোঁজটা নিচ্ছেন আপনারা।  

সবাই ভালো থাকুন, সতর্ক থাকুন আর শারীরিক দূরত্ব মেনে চলেই  সামাজিক ভাবে আরও কাছে থাকুন। 

One Reply to “করোনা সময়ে খোলা চিঠি”

  1. অসাধারণ লেখা! প্রকৃতপক্ষে একজন অভিভাবকই জানেন লকডাউনের এই মুহুর্তে আসলে বাচ্চা নিয়ে কেমন কাটছে। আমরা যারা থেরাপিস্ট, তারা এই মুহুর্তে শুধু পরামর্শই দিতে পারি। আশা করি এই লেখাটির মাধ্যমে অনেক অভিভাবক উপকৃত হবেন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Skip to content