শিশুর নিয়ন্ত্রণহীন জেদ ও করণীয়

Spread the love

তামান্না তাসনিম উপমা
ক্লিনিক্যাল স্পীচ অ্যন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট
ফেইথ বাংলাদেশ

আজকের আধুনিক অভিভাবকেরা সন্তানদের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল। তারা সন্তানদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে এতটাই মনোযোগী যে, তাদের জন্য কোনো কিছুতেই কমতি রাখতে চান না। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর ক্ষেত্রে এই যত্নশীলতা আরও গভীর। আমাদের লক্ষ্য থাকে, সন্তান যেন এক মুহূর্তও কষ্ট না পায় বা কোনো অসুবিধার সম্মুখীন না হয়।

এ কারণেই আমরা প্রায়শই সন্তানের কান্না বা জেদ থামানোর জন্য তার যেকোনো চাহিদা সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করে ফেলি। আমরা তাকে তাৎক্ষণিকভাবে কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি দিয়ে সন্তুষ্ট করি, যাতে সে আর বিরক্তি বা অস্বস্তি প্রকাশ না করে। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি, এই পদ্ধতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হতে পারে? আমাদের এই অতিরিক্ত যত্ন এবং তাৎক্ষণিক চাহিদা পূরণের অভ্যাস শিশুর মধ্যে কী ধরনের আচরণগত পরিবর্তন আনছে?

শিশুর জেদের কারণ প্রভাব 

শিশুর জেদ বা অস্থিরতার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। এগুলো বোঝা এবং চিহ্নিত করা অভিভাবকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সঠিক কারণ চিহ্নিত করলেই কার্যকর সমাধান বের করা সম্ভব। 

জেদের কারণ:

. তাৎক্ষণিক চাহিদা পূরণের অভ্যাস:

   শিশুরা যখন ছোট থেকে শেখে যে কান্না বা জেদ করলেই চাহিদা পূরণ হবে, তখন তারা ধৈর্য এবং অপেক্ষার গুরুত্ব বোঝে না। 

. আবেগ প্রকাশের সীমিত উপায়:

   অনেক শিশু চাহিদা বা আবেগ প্রকাশের জন্য সঠিক ভাষা বা মাধ্যম জানে না। এ কারণে তারা কান্না, চিৎকার, বা জেদকে তাদের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। 

. সীমারেখার অভাব:

   শিশুর জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম বা সীমারেখা নির্ধারণ না থাকলে, সে মনে করে যে তার চাহিদা পূরণ সবসময় নিশ্চিত। 

. মনোযোগের অভাব:

   যখন অভিভাবকরা শিশুর সাথে সক্রিয়ভাবে সময় কাটাতে না পারেন, তখন শিশুর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য জেদ বা কান্না বেড়ে যেতে পারে। 

শিশুর জেদের প্রভাব

. ধৈর্য এবং নিয়ন্ত্রণের অভাব:

   শিশুরা অপেক্ষা করার অভ্যাস গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ফলে সামান্য অসুবিধাতেও তারা হতাশ হয়ে পড়ে। 

. চাহিদার প্রতি আগ্রহ হারানো

   শিশু একসঙ্গে অনেক জিনিস পেয়ে গেলে নির্দিষ্ট কোনো খেলনা বা বস্তুর প্রতি তার আগ্রহ কমে যায়। 

. সমাজে খাপ খাওয়াতে সমস্যা

   আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক নিয়ম না শেখার ফলে ভবিষ্যতে স্কুল, খেলার মাঠ বা সামাজিক পরিবেশে সে সমস্যায় পড়তে পারে। 

. আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি

   সঠিকভাবে চাওয়া বা কোনো বস্তু পাওয়ার পদ্ধতি না জানলে, শিশুর মধ্যে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হতে পারে। 

 শিশুর জেদ নিয়ন্ত্রণে করণীয় 

শিশুর জেদ কমানোর জন্য শুধু তার কান্না থামানোই যথেষ্ট নয়; তাকে ধৈর্য এবং সঠিক পদ্ধতিতে চাওয়া শেখাতে হবে। নিচে কয়েকটি ধাপে করণীয় বিষয় আলোচনা করা হলো: 

. চাওয়ার সঠিক পদ্ধতি শেখান:

শিশুকে শেখান কীভাবে সে তার চাহিদা প্রকাশ করবে। 

  • চোখের যোগাযোগ স্থাপন:

  যখন সে কোনো জিনিস চায় এবং কান্না করে, সরাসরি তা দিয়ে না দিয়ে তার চোখের দিকে তাকান। তার চোখের দিকে আপনার মনোযোগ নিয়ে আসুন। ধীরে ধীরে ১ থেকে ৩ পর্যন্ত গুনুন। এটি শিশুকে শান্ত হতে এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে। 

  • হাত দিয়ে চাওয়া শেখানো

  শিশুকে নির্দিষ্ট জিনিসের দিকে ইঙ্গিত করে ‘দাও’ বলার জন্য বলুন। যদি সে নিজের থেকে না বুঝতে পারে, তার হাত ধরে প্রম্পট দিন এবং তাকে ইশারা করতে শেখান। 

  • পুরস্কার প্রদান:

  যখন সে সঠিকভাবে চায়, তখন তাকে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি দিন এবং সঙ্গে ‘নাও’ শব্দটি উচ্চারণ করুন। এতে সে বুঝবে চাওয়ার এবং পাওয়ার মধ্যে সম্পর্ক। 

. একসঙ্গে অনেক জিনিস দেওয়া থেকে বিরত থাকুন

শিশুর সামনে একসঙ্গে অনেক খেলনা বা বস্তু রাখবেন না। 

– এর ফলে শিশু প্রতিটি জিনিসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং সবকিছু চাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়। 

– নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট খেলনা ব্যবহার করুন এবং পুরস্কার হিসেবে খেলনা প্রদান করুন। 

. ধৈর্যের মূল্য শেখান:

শিশুকে শেখান যে সবকিছু তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায় না। 

– উদাহরণস্বরূপ, খেলনা দেওয়ার আগে ৫ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে বলুন। 

– প্রতিদিন ধীরে ধীরে অপেক্ষার সময় বাড়ান। 

. ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যবহার করুন

শিশুর সঠিক আচরণের জন্য প্রশংসা করুন। 

– উদাহরণস্বরূপ: “ভেরি গুড”, “খুব ভালো হয়েছে”, “তুমি অসাধারণ করেছো” ইত্যাদি। 

– হাততালি বা হাই-ফাইভ দিয়ে তাকে উৎসাহ দিন। 

. আবেগ নিয়ন্ত্রণের চর্চা করান:

শিশুকে শেখান কীভাবে তার রাগ, হতাশা বা অস্থিরতা প্রকাশ করবে। 

– রাগ করলে তাকে ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়ার অনুশীলন করান। 

– তাকে বোঝান যে সব সমস্যার সমাধান কান্না বা জেদ নয়। 

অভিভাবকদের জন্য বিশেষ পরামর্শ 

শিশুর জেদ বা অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অভিভাবকদের ধৈর্য ধরে কাজ করতে হবে। 

. নিয়মিত চর্চা করুন:

   কোনো অভ্যাস বা আচরণ রাতারাতি বদলে যায় না। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে শিশুর সাথে কাজ করুন। 

. সময়সাপেক্ষ পরিকল্পনা করুন:

   শিশুকে ধীরে ধীরে নতুন অভ্যাস শেখান। প্রথমে সহজ কাজ থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে জটিল বিষয়ে নিয়ে যান। 

. অতিরিক্ত যত্ন এড়িয়ে চলুন

   অতিরিক্ত যত্নশীলতা শিশুকে ভবিষ্যতে আত্মনির্ভরশীল হতে বাধা দেয়। তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে এবং নিজেকে প্রকাশ করতে দিন। 

. নিজেদের আচরণেও পরিবর্তন আনুন:

   শিশুর সামনে নিজের আবেগ এবং ধৈর্যের উদাহরণ দিন। শিশুরা বড়দের আচরণ অনুকরণ করে। 

পরিশেষে , শিশুর জেদ এবং নিয়ন্ত্রণহীন আচরণ অভিভাবকদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তবে ধৈর্য, ভালোবাসা এবং সঠিক পদ্ধতির মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। সন্তানের আবেগগত ও সামাজিক দক্ষতা গড়ে তোলার জন্য সচেতন পরিকল্পনা এবং নিয়মিত চর্চার প্রয়োজন। 

সন্তানকে শুধু তার চাহিদা পূরণের মাধ্যমে খুশি না করে, তাকে একজন আত্মবিশ্বাসী, ধৈর্যশীল এবং দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন।

তামান্না তাসনিম উপমা
ক্লিনিক্যাল স্পীচ অ্যন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট
ফেইথ বাংলাদেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Skip to content