বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস এর সংক্রমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যপক পরিবর্তন এনেছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে আমরা বেশিরভাগই নিজ নিজ বাড়ীতে লকডাউন অবস্থায় রয়েছি। লকডাউন এর এই সময়টি বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই কঠিন, তবে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে এটি আরো তীব্র হতে পারে। অনেকেই হয়ত লক্ষ্য করছেন যে অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তি বা শিশুদের আচরণগত সমস্যা, ক্রিয়াকলাপ বা আগ্রহের সীমাবদ্ধতা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক লক্ষণ আগের থেকে আরো বেশি বেড়ে গেছে এই লকডাউন থাকার কারণে।
এই লকডাউনে আমাদের অটিজম আক্রান্ত শিশুদের প্রতিদিনের যে রুটিন কাজগুলো ছিলো তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে, যেমন একই ধরনের খাবার খাওয়া বা সারা দিনে নির্দিষ্ট সময়ে খেলা এবং নির্ধারিত স্থানে যাওয়া ইত্যাদি অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের রুটিন করা কাজগুলোর অনুশীলন একেবারে বন্ধ করে দিলে দিলে এটি অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে যা নিউরোটিপিক্যাল মানুষের চেয়ে অনেক বেশি।
আপনি যদি একজন অটিজম আক্রান্ত সন্তানের অবিভাবক হন তবে আপনি হয়ত ইতিমধ্যে আপনার শিশুটিতে স্কুল বন্ধ এবং রুটিন পরিবর্তনের প্রভাবগুলি দেখেছেন। এই হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন এবং নিত্যদিনের অভ্যাস ব্যাহত হওয়া অটিজম আক্রান্ত বাচ্চাদের এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মেনে নেয়াটা খুবই কঠিন । থেরাপির এপোয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল হয়ে যাওয়া, স্থানীয় দোকানপাট বন্ধ, রেস্টুরেন্ট বন্ধ- এসব বিষয়গুলো একজন অটিজম আক্রান্ত শিশুর মনে তীব্র মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। এরকম পরিস্থিতে তাদেরকে বাসায় নিয়ন্ত্রন করাও কঠিন এবং কোন কোন সময় তাদের আচরণে চিৎকারের পাশাপাশি নিজেকে বা অন্যকে শারীরিকভাবে আঘাত করাও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
এই মানসিক চাপের আরো কিছু নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। যেমন- শিশুটি পুরোপুরি নিরব হয়ে যেতে পারে, চলাফেরা কম করতে চাইতে পারে, অথবা তুলনামূলক নিরব জায়গায় নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে। একের অধিক কমান্ড বা নির্দেশনা নিতে শিশুর সমস্যা হবে, অনেকটা হ্যাং হয়ে যাওয়া একটি কম্পিউটারের মতো যেখানে অনেক বেশি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, কিন্তু সেটি প্রসেস করা সম্ভব হয়নি।
অনেক বেশি অস্থির হয়ে যাওয়া বা অতিরিক্ত শান্ত আচরন করা- এই দুটোই শিশু এবং বাবা-মায়ের জন্যে সমস্যার। তাই এই পরিস্থিতিগুলিকে সর্বনিম্ন রাখার জন্য ও মোকাবেলায় সহায়তা করার জন্য কিছু উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমনঃ
কী চলছে তা ব্যাখ্যা করার সময় শান্ত থাকুন
এই নতুন জীবনযাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রাখা অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠতে পারে । বিশেষজ্ঞগণ এর মতে, এ সংকটময় সময়ে যে জিনিসটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হল শান্ত থাকা । এমনকি আপনার শিশুটি যদি কথা বোঝা বা বলতেও না পারে, তারপরও সে আপনার কথা বলার টোন বা ভঙ্গী, আপনার কাজের ধরণ সে অনেকক্ষেত্রে ধরতে পারে। তাই শিশুর সামনে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক আচরণ করা উচিত, যেন আপনার স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন করতে না পারে।
যদি আপনার সন্তান কথা বলতে ও বুঝতে পারে, তাহলে তার সাথে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কথা বলার সময় তাকে বিষয়টি সম্পর্কে কতটুকু জানাবেন সেটির একটি পরিকল্পনা করুন এবং সাবধাণতার সাথে টপিক সাজিয়ে নিন, যেন সে আতংকগ্রস্থ হয়ে না পড়ে। যদি সম্ভব হয়, তবে তথ্যকে মজাদার করে তুলুন যেন আপনার সন্তান সহজেই নিতে পারে । আপনার সন্তান যা শুনছে তা প্রক্রিয়া করার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিন, যাতে সে জানতে পারে যে তার আশেপাশে কি হচ্ছে এবং এ সময়ে কি কি করণীয়।
প্রতিটি দিনের একটি কাঠামো দিন
অটিজম আক্রান্ত শিশুরা এই মুহুর্তে যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা বোধ করছে তার মধ্যে প্রধান হলো তাদের প্রতিদিনের রুটিনটি কতটা পরিবর্তিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাবা মায়ের উচিত শিশুর প্রতিদিনের কার্যকলাপের একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে ব্যয়াম, খাওয়া-দাওয়া এবং মজার খেলার জন্য সময় তৈরি করা। আপনার শিশু পরের দিন কী করবে তা আগের দিনেই যদি জানতে পারে তাহলে তারা আরও ভালভাবে কাজ করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে শিশু যদি লেখা পড়তে জানে, তবে কাগজে লিখে দিতে পারেন পরবর্তিতে কি কাজ করতে হবে। এছাড়াও ভিস্যুয়াল শিডিউল এখানে ভাল একটি কাঠামো হিসেবে কাজ করতে পারে।
- সময়সূচিটি কাগজের টুকরোতে লিখে নিন এবং এটি দেয়ালে লাগাতে পারেন বা ফ্রিজে ম্যাগনেট দিয়ে পিন করতে পারেন।
- লেখা বা ছবি গুলো দেখিয়ে শিশুকে বার বার মনে করিয়ে দিন যে কোন কাজের পর কোন কাজ করা হবে।
- গৃহস্থালী কাজে শিশু যেন সম্পূর্ণরূপে বা স্বেচ্ছায় অংশ নিতে আগ্রহী হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন । শিশুর সামনে কাজগুলোকে মজাদার বা আকর্ষণীয় করে তুলুন, যেমনঃ মজার কোন ছন্দ বা গান আর শারীরিক অঙ্গভঙ্গি করে শিশুকে ঘর গোছানো শেখাতে পারেন। এর মাধ্যমে শিশু ঘর গোছানো সম্পর্কিত বিভিন্ন নতুন শব্দ ও শব্দের প্রয়োগ শিখতে পারবে।
- ঊপযুক্ত রিইনফোর্সমেন্ট প্রদান করুনঃ শিশু কাজটি সহজভাবে সম্পন্ন করতে পারলে, তার কৃতিত্বের ফটোগ্রাফ বা ভিডিও সংরক্ষণ করতে রাখতে পারেন যেন ভবিষ্যতে তা তাকে দেখাতে পারেন। এতে তার আত্মমর্যাদা বাড়বে ।
একটি নিরাপদ সেন্সরি স্পেস তৈরি করুন
লকডাউনে অকুপেশনাল থেরাপি বন্ধ, সাথে সাথে বাইরে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শিশুর সেনসরি এনভায়রনমেন্ট পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞ থেরাপিস্টরা বলছেন বাবা মায়ের উচিত বাচ্চাদেরকে বাসাতেই স্কুল বা থেরাপি সেন্টারের আদলে যতটুকু সম্ভব একটি সেন্সরি স্পেস তৈরি করে দেয়া। যদি বাচ্চার উচ্চ শব্দে সংবেদনশীলতা বেশি থাকে, তাহলে তাকে একটি নয়েজ ক্যানসেলিং বা শব্দ আটকে দেয় এমন একটি হেডফোন দেয়া যেতে পারে যেটা সে কানে পড়বে, অথবা বাসার একটি নিরব অংশে তার সেন্সরি স্পেস তৈরি করে দেয়া যেতে পারে যেন প্রয়োজনে সে সেখানে গিয়ে শব্দ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে।
এই সেন্সরি স্পেস একটি সাময়িক ভাবে তৈরি করা অঞ্চল যেখানে বিভিন্ন সংবেদনশীল খেলনা নিয়ে খেলার এবং কাজ করার পূর্ণ আয়োজন থাকবে, সেখানে তারা কিছুটা একা সময় কাটাবে এবং শান্ত হতে পারবে তাই এই পদক্ষেপটি বেশ ভালো কাজ করে ।
অনলাইনে থেরাপিউটিক সামগ্রী বা কৌশল সন্ধানের পরিবর্তে থেরাপিস্টের সাহায্য নিন
লকডাউন অবস্থায় অনেক বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই যারা স্পিচ, ফিজিও বা অকুপেশনাল থেরাপির সেবা নিয়ে থাকে বা বড় বাচ্চারা প্রতিকারমূলক কেন্দ্রে বা বিশেষ স্কুলে যায়, তাদের বাবা- মায়েরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন । কারণ তাদের কাছে বাড়িতে পুরো প্রোগ্রামটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা সমদক্ষতা থাকে না, তাই দিশেহারা হয়ে অনলাইনে বিভিন্ন থেরাপিউটিক সামগ্রী কেনা বা থেরাপিউটিক কৌশল সন্ধানে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন । এক্ষেত্রে একটা বিষয় মাথায় রাখা উচিত যে অনলাইনে পাওয়া তথ্যসমূহ তাদের সন্তানের পক্ষে উপযুক্ত নাও হতে পারে। থেরাপিস্ট বা শিক্ষকদের সহায়তা নিয়ে তারা তাদের সন্তানের স্বতন্ত্র লক্ষ্যে অবিরত কাজ করতে পারেন ।
আপনার পরিবারের সমর্থন অত্যন্ত প্রয়োজন
শিশুকে ভাল রাখতে হলে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ভাল থাকা। লকডাউন পরিস্থিতি একটি মানসিক চাপের সময় এবং যদি বিষয়গুলি সংকটাপণ্ণ হয়ে আসে তখন আপনার উচিত ফোনে বন্ধুদের এবং পরিবারের সাথে কথা বলার মাধ্যমে নিজের মানসিক মনোবল নিশ্চিত করা । এছাড়াও, কোন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি না হয়ে পরিবারের সকল বাক্তিকেই নির্দিষ্ট সময়ে কিছু কাজ বা খেলার মাধ্যমে শিশুকে নতুন শব্দ বা কাজ শিখতে সাহায্য করা উচিত, এতে শিশুর একঘেয়েমি লাগবে না আবার পরিবারের সকলের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করতে পারবে।
পরিবারের সবার অবশ্যই নিজেদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে
এসময় শিশুর বাবা-মা বা এর উপর যথেষ্ট চাপ থাকবে এটাই স্বাভাবিক, কারণ তাদের কাজ এবং দায়িত্বগুলো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তাদের পরিবারের কাজগুলি পরিচালনা করতে হয় সাথে অটিজম আক্রান্ত শিশু এবং অন্যান্য নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যদের যত্ন নিতে হয়। দিনশেষে বাবা-মায়েরই আর নিজেদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়া হয় না।
এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের নিজের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিশ্চিত করতেঃ
- পরিবারের সকল সদস্যদের উচিত তাদের জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য প্রতিটি দিনকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং সেগুলি সম্পন্ন করার পরিকল্পনা তৈরি করা ।
- সময় বা শক্তি অনুযায়ী পরিবারের প্রত্যেককে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া উচিত এবং অটিজম আক্রান্ত শিশুকে ধারাবাহিকভাবে সমর্থন করার পরিকল্পনা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত পারিবারিক সভা করুন।
- প্রয়োজনে পছন্দের গান শুনুন বা বাসার ছাদে বা বারান্দায় (যদি সম্ভব হয়) বসে প্রকৃতি উপভোগ করুন।
বিশ্বাস করুন যে আপনার সন্তানরা আপনার চেয়েও বেশি প্রতিভাবান হতে পারে এবং আপনিও সেগুলি থেকে শিখতে পারেন
আপনার সন্তানের সহনশীলতার উপর বিশ্বাস রাখুন । দুঃখজনক হলেও, অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্যে সামাজিক দূরত্ব নতুন কিছু নয়। সমাজ এর অনেক শিক্ষিত মানুষ এখনো অটিজম সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারনে অটিজম আক্রান্ত শিশু ও তার পরিবারের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে – এটা বাস্তব সত্য। শিশু কথা না বললে বা বুঝতে না পারলেও এই বিষয়গুলো অনুভব করতে পারে। এই পরিস্থিতিগুলো মোকাবেলা করার মত তাদের নিজস্ব কিছু কৌশল এবং ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শান্ত থাকুন, অনলাইনে সকলের সাথে সংযুক্ত থাকুন এবং ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখুন । নিরাপদ ও সুস্থ থাকুন। অবশ্যই এ সংকটময় সময়ের একদিন অবসান হবে।
সাবরিনা হোসেন তৃষা
ক্লিনিক্যাল স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট
ফেইথ বাংলাদেশ
১/১৫ এ, ইকবাল রোড
মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
হটলাইনঃ +৮৮০১৭৮৩২৪৮৪২৩
ওয়েবসাইটঃ www.faithbangladesh.org/services