অনুভূতি বিষয়ক ধারণা

Spread the love

মুল লেখাঃ ডঃ স্টিভেন শোর

সহকারী অধ্যাপক, দ্যা কলেজ অভ এডুকেশন অ্যান্ড হেলথ সায়েন্সেস, এডেলফি ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

ভাবানুবাদঃ নবাগত দাস, হেড, থেরাপিউটিক ইউনিট, ফেইথ বাংলাদেশ

অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে সফল ভাবে কাজ করতে হলে তারা পৃথিবীটাকে কিভাবে উপলব্ধি করে সেটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমি যেটা দেখি তুমি কি সেটা দেখ?

আমি যেটা শুনি তুমি কি সেটা শোনো?                                                                            

আমি যেটাকে অনুভুতি হিসেবে উপলব্ধি করি, তুমি কি তেমনটাই করো?

-“সিলিং এর ওটা কি ফ্লুরোসেন্ট লাইট… নাকি ওটা স্ট্রোব লাইট?”

-“ স্কুলের ক্লাসরুম ভর্তি বাচ্চারা যখন তাদের খাতায় খসখস শব্দ করে লেখে, সেটা কি শুনতে পাও?”

উপরের দুটো একজন অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তি তার দৈনন্দিন জীবনে কেমন অনুভব করে, সাধারন মানুষের অনুভুতির সাথে তার পার্থক্য কতটুকু, সেটার সামান্য উদাহরণ মাত্র।        

The Diagnostic and Statistician’s Manual of Mental Disorders (DSM 5) (American Psychological Association, 2013) সহ  বেশিরভাগ তথ্যের উৎসগুলোতে  যোগাযোগ, সামাজিক মেলামেশা, সাথে সাথে পুনরাবৃত্তিমুলক নড়াচড়া এবং কোন কিছুর প্রতি অস্বাভাবিক আসক্তিকে অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তির প্রধান সমস্যা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।  কিন্তু  DSM 5 বা অন্যান্য রেফারেন্স গুলোতে অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তির জন্যে সেনসরি ইন্টিগ্রেশন এর গুরুত্ব তেমন ভাবে বর্ণনা করা হয়নি।

সেনসরি ইন্টিগ্রেশন এবং সেনসরি ইন্টিগ্রেশন ডিসফাংশন

সেনসরি ইন্টিগ্রেশন কি? সেনসরি ইন্টিগ্রেশন হচ্ছে “প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহারের জন্য আমাদের দেহ এবং চারপাশের বিশ্ব থেকে প্রাপ্ত তথ্য সজ্জিত করার স্নায়ুবিক প্রক্রিয়া”(Kranowitz, 1998, p. 42).”সেনসরি ইন্টিগ্রেশন ডিসফাংশন হ’ল ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য প্রক্রিয়া করার অক্ষমতা” (p.8)। সহজ কথায় আমাদের চার পাশের পরিবেশকে আমরা সাধারণ ভাবে যেভাবে উপলব্ধি করব বলে বিবেচনা করি, বলতে গেলে আমার পরিচিত অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তির প্রায় সবাই তার থেকে অনেক ভিন্নভাবে উপলব্ধি করে। কিছু অনুভুতি হতে পারে “অনেক তীব্র”, আবার কিছু হতে পারে “অনেক মৃদু” এবং ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যগুলিতে প্রচুর পরিমাণে বিকৃতি হতে পারে।    

বাহ্যিক অনুভূতির ইন্দ্রিয়সমূহ

বেশীরভাগ মানুষই ৫ টি  ইন্দ্রিয়ের অনুভুতি- দৃষ্টি, শব্দ, স্বাদ, গন্ধ ও স্পর্শ সম্পর্কে জানে।

Temple Grandin’s (1995) এর লেখা একটি বই এর থিওরি বা তত্ত্ব অনুযায়ী, যারা অটিজম স্পেক্ট্রাম নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন তাদের Nerve ending (স্নায়ুর পরিসমাপ্তিঃ দেহের পৃষ্ঠের এবং এর ভিতরে লক্ষ লক্ষ পয়েন্ট যা তাপ, শীত এবং ব্যথার মতো সংবেদন অনুভব করলে আপনার মস্তিষ্ককে বার্তা দেয়) এর সংখ্যা থাকে অনেক বেশি, কিন্তু হয় প্রিম্যাচিউর বা অপরিপক্ক। এই থিওরিটি অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কেন সেনসরি ইন্টিগ্রেশন নিয়ে এত সমস্যা অনুভব করে তার একটি সম্ভাব্য কারণ বর্ণনা করে। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের কোন কোনটি অত্যাধিক সংবেদনশীল আবার কোনটি অনেক কম সংবেদনশীল হতে পারে। এছাড়াও এই ইন্দ্রিয়গুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিকৃত হয়ে যেতে পারে। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি জনিত যে সমস্যা একজন অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তি অনুভব করতে পারে সেটা হল-

“ আমার এক বা একাধিক ইন্দ্রিয়ের অনুভুতিগুলোকে অতিরিক্ত চাপ দেয় এমন যেকোন কিছুই আমার জন্যে সেন্সরি ভায়োলেশন এবং কষ্টকর”।

অভ্যন্তরীন অনুভূতির ইন্দ্রিয়সমুহ

ভেস্টিবুলার ও প্রোপিওসেপটিভ এর অনুভুতিগুলোকে কখনো কখনো লুকায়িত বা অভ্যন্তরীন অনুভূতি বলা হয়।  ভেস্টিবুলার সেন্স “ নড়াচড়া, দেহভঙ্গি, দৃষ্টি, ভারসাম্য বজায় রাখা এবং শরীরের দুই পাশের মাঝে সমন্বয় বজায় রাখতে সাহায্য করে” (Myles, Cook, Miller, Rinner & Robbins, 2000, p. 28). প্রোপ্রিওসেপশন একজন ব্যক্তিকে জানায় যে শুন্যে তার শরীরের কোন অংশের অবস্থান কোথায় এবং কোন কাজ করতে ঠিক কতটুকু শক্তি প্রয়োগ করা প্রয়োজন- যেমন এক গ্লাস দুধ তুলতে কতটুকু শক্তি লাগতে পারে।  বাহ্যিক ইন্দ্রিয় গুলোর অনুভূতির মতই এই দুই অনুভূতির (ভেস্টিবুলার ও প্রোপিওসেপটিভ) হাইপার সেন্সেটিভিটি বা “তীব্র সংবেদনশীলতা” ও হাইপো সেন্সেটিভিটি বা “মৃদু সংবেদনশীলতা” ও প্রাপ্ত তথ্য বিকৃতি অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনকে আরো চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।           

নিচের “স্টার’ টি একজন অটিজম স্পেকট্রামে আক্রান্ত ব্যক্তি কি কি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তার কিছুটা বর্ণণা করে।

নিজের একটি অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলি- আমি এসপারগার্স সিন্ড্রোম আছে এমন একজন বন্ধুর সাথে একই রুমে ছিলাম। হঠাৎ করে আমি লক্ষ্য করলাম, তার চোখের মনি আগে পিছে নড়াচড়া করছে , ঠিক সিলিং এর ফ্লুরোসেন্ট লাইটটা যেভাবে কাঁপছে। আসলে তার কাছে মনে হচ্ছিল যে সে স্ট্রোব লাইট আছে এমন একটি ঘরে বসে আছে।  তার মত অনেক অটিজম স্পেকট্রামে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছেই ফ্লুরোসেন্ট লাইট কে স্ট্রোব লাইটের মত  দ্রুত জ্বলছে নিভছে বা ঘুরছে বলে মনে হয়।  কিন্তু যাদের অটিজম নেই তারা তখনই লাইটের জ্বলা-নেবার মত এই অনুভুতি কিছুটা পাবেন যখন লাইটের বাল্ব অনেক পুরোনো হবে এবং পরিবর্তন করার প্রয়োজন হবে।     

কিছুক্ষণ পরে সে আমাকে বলল- “ আমরা কি এইখান থেকে বের হয়ে যেতে পারি?”, এবং আমরা সাথে সাথেই সেই জায়গা থেকে সরে আসি।  সৌভাগ্যবশত তার সমস্যা প্রকাশ করার মত প্রয়োজনীয় যোগাযোগ দক্ষতা রয়েছে এবং ঐ ঘর পরিবর্তন করে তার চারপাশের পরিবেশ পরিবর্তন করতে পারে।

গ্রেড স্কুলে পড়া একটা ৮ বছরের বাচ্চার ক্ষেত্রে ব্যপারটা কিরকম?

সেও একই রকম ভাবে অনুভব করবে যে সে একটা স্ট্রোব লাইট এর পাশে বসে আছে।

আপনি কিভাবে এটা আশা করেন যে সেই বাচ্চাটি মনোযোগ দিয়ে তার টিচার বা ইন্সট্রাক্টর এর কথা শুনে একটা ওয়ার্কশিট পূরণ করবে, যেখানে যেটা কিনা অন্য সাধারণ মানুষের কাছে স্ট্রোব লাইটের মত, সেটা দিয়ে সে ক্রমাগত ভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে?

ধরুন, সে সিট থেকে উঠে গিয়ে লাইট টা বন্ধ করতে চাইলো। তার টিচার, তাকে চেয়ার ছেড়ে উঠতে দেখে বসে থাকতে বলল। এরকম কয়েকবার হলো, এবং টিচার তাকে শেষ পর্যন্ত প্রিন্সিপালের রুমে পাঠিয়ে দিলেন শাস্তির জন্যে!

চলুন এবার একটা ৪ বছরের অটিজম স্পেকট্রামে আক্রান্ত এবং কথা বলতে পারেনা এমন একটি বাচ্চার কথা চিন্তা করি। সেও একটি রুমে বসা, এবং যেটা তার কাছে স্ট্রোব লাইটের মত মনে হচ্ছে সেটা তার ভিস্যুয়াল সেন্স বা দৃষ্টির অনুভুতিকে তীব্রভাবে আলোড়িত করছে। দুর্ভাগ্যবশত, তার বুদ্ধিবৃত্তিয় ও যোগাযোগের দক্ষতা অত ভাল নয় যে সে তার টিচারকে বলবে যে লাইটগুলো তাকে কষ্ট দিচ্ছে।  এটাও খুবই স্বাভাবিক যে সে হয়ত বুঝতেই পারছে না যে লাইটের সুইচ অফ করলে লাইটটা বন্ধ হয়ে যাবে। সবশেষে আপনি ফলাফল কি পেলেন? বাচ্চাটার কান্নাকাটি, চিৎকার ও দুর্বার ক্রোধ!  

আমি এই লেখায় অনেকগুলো সম্ভাবনা থেকে একটি মাত্র সম্ভাবনার দিকে জোর দিয়েছি যেখানে একজন অটিজম স্পেকট্রামে আক্রান্ত ব্যক্তি তার সেন্সরি ওভারলোড এর কারনে হঠাৎ সিট থেকে উঠে যাওয়ার মত আচরন দেখায়।  এটা বোঝা গুরুত্বপুর্ণ যে, অটিজম স্পেকট্রামে আক্রান্ত ব্যক্তির কোন চ্যালেঞ্জিং আচরণ এর কারণ হিসেবে সেন্সরি ওভারলোড এর  সম্ভাবনাও বিবেচনায় রাখা জরুরী।        

References

American Psychiatric Association. (2013). Diagnostic and statistical manual of mental disorders of the American Psychiatric Association (5th. ed.). Washington, DC: Author.

Kranowitz, C. 1998. The out of sync child: Recognizing and coping with sensory integration dysfunction. New York: Skylight Press.

Grandin, T. (1995). Thinking in pictures: And other reports from my life with autism. New York: Doubleday.

Smith-Myles, B., Cook, K., Miller, N., Rinner, L., & Robbins, L. (2000). Asperger Syndrome and sensory issues: Practical solutions for making sense of the world. Shawnee Mission, KS: Autism Asperger Publishing Company.

3 Replies to “অনুভূতি বিষয়ক ধারণা

  1. একটি সম্পুর্ণ ভিন্ন মাত্রার অনুবাদ। খুবই প্রয়োজনীয় ও তথ্য বহুল লেখাটিতে সহজ শব্দ সন্নিবেশ করায় লেখাটির বিপুল ব্যবহার আশা করছি। তবে ছকের ভিতরের অংশটুকু আরো সুষ্পষ্ট করলে এবং ইংরেজি মূল লেখাটি সংযোজন করলে পাঠকদের জন্য সুবিধা হবে বলে আমার বিশ্বাস। সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

  2. ধন্যবাদ, সাবলীল উপস্থাপনের জন্য। সম্ভব হলে অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের এ ধরনের তীব্র বা অসুবিধাজনক অনুভুতির management (ঘরোয়া/অভিভাবক পযায়ে) নিয়ে লিখলে উপকৃত হব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Skip to content