বাংলাদেশে শিশুর ভাষাগত ও মানসিক বিকাশ ঠিক মত হচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে এখনো পর্যন্ত সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এখনো আমরা এই গুরুত্বপুর্ন বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখি না। এখনো আমাদের ধারণা রয়েছে শিশু ঠিক মত খাবার খেলে, ঠিক মত ঘুমালে, ব্যথা না পেলে নিজে নিজেই সঠিক ভাবে বেড়ে উঠবে। আবার অনেক বাবা-মা ই হয়ত কিছুটা বুঝতে পারেন ব্যপারটা, কিন্তু কাজের চাপে এ বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার সময় পান না। বাবা-মা শিশুকে কাজের বুয়ার কাছে রেখে অফিস চলে যান জীবিকার তাগিদে। শিশু সারাদিন হয়ত টিভিতে কার্টুন দেখছে, বা মোবাইল এ ইউটিউবে রাইমস দেখছে। ফলে কিভাবে মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, শিশু সেটা শিখছে না। কার্টুনের ভাষা, কার্টুন ক্যারেক্টারের নড়াচড়াই তখন শিশুর কাছে বাস্তবতা। শিশু কান্না করলেই তাকে থামানোর জন্যে হাতে তুলে দিচ্ছি তার পছন্দের জিনিসটি। পরিনতি হিসেবে বাচ্চা শিখছে কোন কিছু চাইতে হলে কান্না করতে হবে। শিশু জেদি হয়ে উঠছে। শিশুর এই জেদ সামলানোর জন্যে কখনো কখনো শিশুকে চাইবার আগেই তার হাতে তুলে দিচ্ছি তার প্রয়োজনীয় জিনিসটি। ফলে শিশুর কোন চাহিদা থাকছে না, কথা বলার প্রয়োজনীয়তাও সে অনুভব করতে পারছেনা। শিশুকে অনেক দামী দামী খেলনা কিনে দিচ্ছি বটে, কিন্তু সেই খেলনা দিয়ে কিভাবে খেলতে হয় সেটাই শিখিয়ে দিচ্ছিনা, বা শিশুর সাথে সেই খেলনা গুলো দিয়ে খেলছিনা মোটেই। শিশুর সাথে যে পরিমান কথা বলা প্রয়োজন, সে পরিমান কথা বলছি না। অনেক ক্ষেত্রেই হয়ত লক্ষ্য করছি শিশু কথা বলছে না বা বুঝতে পারছে না, তারপরও আমরা অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিই। পরিবারের ইতিহাস টেনে আনার চেষ্টা করি- “বাচ্চার বাবাও পরে কথা বলেছে, ও কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে।“ ফলাফল স্পিচ-ল্যাঙ্গুয়েজ ডিলে/ ডিসঅর্ডার।
স্পিচ-ল্যাঙ্গুয়েজ ডিলে/ ডিসঅর্ডার বা সময় মত কথা না বলা বা বোঝার সাথে আরেকটি বিষয় ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সেটি হচ্ছে Autism Spectrum Disorder (অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার) বা ASD.অটিজম শব্দটির সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। একটু চোখ কান খোলা রাখলেই দেখা যায় যে আমাদের আশেপাশেই এ সমস্যার আক্রান্ত শিশু রয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী এ সমস্যায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা যেন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের Centre for Disease Control and Prevention (CDC) এর ২০১৪ সালের গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৬৮ টি শিশূর মাঝে ১ টি শিশু অটিজম এ আক্রান্ত, এবং ছেলে শিশুর এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা মেয়ে শিশুর থেকে ৪.৫ গুন বেশী। যমজ শিশুর ক্ষেত্রে, যদি একটি শিশুর অটিজম থাকে, তাহলে অন্য শিশুটির অটিজম এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৩৬-৯৫ ভাগ। কোন বাবা মায়ের একটি শিশু অটিজমে আক্রান্ত হলে পরবর্তী শিশুটির অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২%-১৮%। (তথ্যসুত্রঃ www.cdc.gov, ২০১৭)
অটিজম কোন রোগ নয়। এটি মস্তিস্কের স্নায়ুবিকাশ জনিত একটি সমস্যা। এখনো পর্যন্ত অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সঠিক কোন কারন আবিষ্কৃত হয়নি। যদিও অটিজমে আক্রান্ত প্রতিটি শিশুই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে এবং আলাদা আলাদা ভাবে বেড়ে ওঠে, গবেষনায় দেখা গেছে যে অটিজম এর লক্ষণগুলো দ্রুত সনাক্ত করা সম্ভব হলে এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হলে অনেক ক্ষেত্রেই অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। দ্রুত অটিজম এর লক্ষন সনাক্ত করার জন্যে বাবা মায়ের অটিজম এর “রেড ফ্ল্যাগ” গুলো জানা প্রয়োজন। নিচের লক্ষন গুলোর কোনটি যদি কোন শিশুর সাথে মিলে যায়, তাহলে বলা যায় যে সেই শিশুটি ভবিষ্যতে অটিজম এ আক্রান্ত হতে পারে, এবং দেরি না করে অতিসত্বর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা প্রয়োজন। সেগুলো হচ্ছে-
- শিশু ৬ মাস বা তার থেকে বেশী বয়সে যদি বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে না হাসে।
- ৯ মাস বয়সের মাঝে শিশুর সামনে মুখ দিয়ে বিভিন্ন মজার শব্দ করলে যদি শিশু সেই শব্দ অনুকরণ (Sound imitation) করার চেষ্টা না করে বা মুখভঙ্গি (Facial Expression ) নকল করার চেষ্টা না করে।
- শিশু যদি ১২ মাস বয়সের মাঝে বা-বা-বা/ পা-পা-পা (Bubbling) ইত্যাদি শব্দ না করে ও শব্দ নিয়ে খেলার চেষ্টা না করে।
- ১২ মাস বয়সে যদি কিছু ইশারা, যেমন আঙ্গুল দিয়ে কোন কিছু নির্দেশ করা (Pointing) বা কোন কিছু দেখানোর চেষ্টা , হাত নেড়ে টাটা দেয়া, কোন কিছু ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি না করে।
- ১৬ মাস বয়সে কিছু অর্থবোধক শব্দ (কোন প্রানী/বস্তুর নাম) না বললে।
- ২৪ মাস বা দুই বছর বয়সে ২ শব্দ বিশিষ্ট ছোট বাক্য (two-word phrases) দিয়ে কথা না বললে; যেমন- “পানি খাব”।
- ২ বছর বয়সের ভিতরে কোন বস্তু বা নিজের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (হাতের আঙ্গুল, মুখ) ইত্যাদি নিয়ে বার বার একই রকম ভাবে নাড়ালে বা অস্বাভাবিক ভাবে খেলা শুরু করলে।
- যেকোন বয়সে মুখ দিয়ে শব্দ করা , ইশারা করা, কথা বলা, বা সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলে।(তথ্যসুত্রঃ https://www.autismspeaks.org/what-autism/learn-signs,২০১১)
উল্লেখিত বিষয়গুলোর যে কোন একটি চোখে পড়লে সাথে সাথে একজন অভিজ্ঞ শিশু বিষেষজ্ঞ এর শরনাপন্ন হওয়া উচিত এবং দ্রুত থেরাপিউটিক ইন্টারভেনশন শুরু করা প্রয়োজন। অটিজম যদি সনাক্ত হয়েই যায়, বাবা মা অনেক বেশি হতাশ হয়ে পড়েন। কারণটা সহজেই অনুমেয়। বিজ্ঞানের এমন উৎকর্ষতার যুগেও অটিজম সম্পুর্ণরুপে ভাল হয় এমন চিকিৎসা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। এ বিষয়ে গবেষনা চলছে প্রচুর, হয়ত সেদিন আর দূরে নয় যেদিন আমরা সফল হব এ বিষয়ে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত অটিজম এর ব্যবস্থাপনাকেই প্রধান চিকিৎসা হিসেবে ধরা হয়।
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার মাঝে রয়েছে, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি ও বিহেভিওর মডিফিকেশন থেরাপি। একজন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট কাজ করবেন কিভাবে শিশুর ভাষা বোঝা বা বলার দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায় এ বিষয়ে। একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট কাজ করবেন শিশুর দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজগুলো কিভাবে শিশু দক্ষতার সাথে করবে সে বিষয়ে। একই সাথে এধরনের শিশুর কিছু সেন্সরির সমস্যা থাকতে পারে, যেটা নিয়েও একজন অকুপেশোনাল থেরাপিস্ট কাজ করবেন। বিহেভিয়র মডিফিকেশন থেরাপিস্ট কাজ করবেন বাচ্চার আচরনগত সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্যে।
তবে শিশুর বাবা মা কে একটি বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশী চিন্তিত দেখা যায় , এবং সেটি হচ্ছে শিশুর কথা না বলা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপির মাধ্যমে শিশুর কথা বোঝার ক্ষমতা বাড়ছে, সে বিভিন্ন নির্দেশ অনুসরন ও করছে, অকুপেশনাল থেরাপির মাধ্যমে বাচ্চা অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে, আচরনগত অনেক পরিবর্তন ও এসেছে। কিন্তু তারপর ও শিশুর মধ্যে কথা বলার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
অনেক শিশুর বাবা মায়ের ধারনা থাকে, এবং পুর্বে এ ধারণা ছিল যে যদি কোন অটিজম আক্রান্ত শিশু ৫ বছরের মধ্যে কমিউনিকেটিভ স্পিচ বা কথা বলা শুরু না করে, তবে সেই শিশুর ভবিষ্যতে কথা বলতে শেখার সম্ভাবনা খুবই কম। ২০০৯ সালে একটি গবেষনায় ব্যাপকভাবে এ বিষয়ে খতিয়ে দেখা করা হয় কম্প্রিহেন্সিভ লিটারেচার রিভিউ এর মাধ্যমে। এক্ষেত্রে গবেষকগণ ২০০৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ম্যানুয়ালি ও ইলেক্ট্রনিক্যালি ইংরেজি ভাষায় লিখিত অটিজম বিষয়ক অসংখ্য গবেষনা পর্যালোচনা করেন। গবেষনায় ১৬৭ জন অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পর্কে জানা যায়, যারা ৫ বছর বা তার অধিক বয়সে কথা বলা শুরু করেন, এবং এর মাঝে ১৩ বছর বয়সেও কথা বলা শুরু করেছেন এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। (তথ্যসুত্রঃ https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/19372766, ২০০৯)
গবেষনায় আরো দেখা গেছে যে যেসকল শিশু কিছুটা কথা বলা শিখেছে, পরবর্তিতে তাদের কথা বলতে পারার সক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এটা প্রমান করে যে যেসব অটিজমে আক্রান্ত শিশু মুখ দিয়ে উদ্দেশ্যমুলক ভাবে কিছু শব্দ করা বা পুনরাবৃত্তি করা শিখেছে , তাদের ভবিষ্যতে কথা বলার মাধ্যমে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে পারার বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। (তথ্যসুত্রঃ https://www.autismspeaks.org/science/science-news/later-language-acquisition, ২০১০) এটা অবশ্যই আমাদের জন্যে আশার খবর।
বাবা মায়ের প্রতি অনুরোধ, শিশু অটিজম এ আক্রান্ত হলে হতাশায় ভেঙ্গে পড়বেন না। আশা রাখুন নিজের উপর, আশা রাখুন নিজের শিশুর উপর। তাকে সুযোগ দিন পৃথিবীটা বুঝে নেবার। সে জন্যে তার আমাদের সবার সাহায্য প্রয়োজন। দ্রুত সনাক্ত হলে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি অটিজম এ আক্রান্ত শিশুকে অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসা সম্ভব। আর এর জন্যে প্রয়োজন আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা , হাল না ছাড়ার প্রত্যয় আর অপরিসীম ধৈর্যশক্তি। জয় একদিন আমাদের হবেই…… সবাই রইলাম সে দিনের অপেক্ষায়…
লেখকঃ
নবাগত দাস
বিভাগীয় প্রধান, থেরাপিউটিক ইউনিট
ফেইথ বাংলাদেশ
১/১৫ এ, ইকবাল রোড
মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
হটলাইনঃ +৮৮০১৭৮৩২৪৮৪২৩
ওয়েবসাইটঃ www.faithbangladesh.org/services