করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে অটিজম আক্রান্ত শিশুর জন্যে বাসায় করণীয়

Spread the love

করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর সংক্রমন বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এক আতঙ্কের নাম। মানুষের চুলের থেকেও প্রায় ৯০০ গুণ সূক্ষ্ম এবং অত্যন্ত সংক্রামক এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে মানবদেহে৷ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস।  বাংলাদেশ ও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা সবাই জানি যে এখনো পর্যন্ত যেহেতু মানবদেহে কার্যকরভাবে ব্যবহারযোগ্য কোন প্রতিষেধক বা প্রতিকার আবিষ্কৃত হয়নি এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে, তাই সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং হলো এই মুহুর্তে করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার সর্বোত্তম উপায়।  বেশ কিছু দিন হলো বাংলাদেশে সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।  এর মাঝে আমাদের অটিজম এ আক্রান্ত শিশুদের বিশেষায়িত স্কুলগুলোও রয়েছে।  আমরা সবাই জানি, বেশিরভাগ অটিজম আক্রান্ত শিশূরাই রুটিন মেনে চলতে পছন্দ করে।  স্কুল গুলো বন্ধ থাকায় আমাদের এই শিশুদের প্রতিদিনের সময়সূচিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। শুধু তাই নয়, এই পরিস্থিতিতে খেলার মাঠ, পার্ক বা অন্যান্য বিনোদনকেন্দ্র গুলোও বন্ধ থাকায় এই শিশুরা অনিশ্চয়তা, নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং উদ্বেগ অনুভব করছে । কেউ কেউ হয়ত সারাদিন কাঁদছে, কেউ কেউ ছুটে বের হয়ে যেতে চাইছে বাসা থেকে। এটা ছাড়াও এই দীর্ঘ সময় বাসায় থাকার কারনে পরবর্তীতে স্কুলগুলো খুললে পুনরায় রুটিনের একটি বড় পরিবর্তন হবে, যা সামাল দেয়া হবে দূরহ ও সময়সাপেক্ষ।

এই লেখাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে এই পরিস্থিতিতে ঘরে বসে অটিজম আক্রান্ত শিশুর অভিভাবকগন কিভাবে কাজ করতে পারেন সেটির ধারণা দেয়া, যাতে করে কিছুটা হলেও আমরা আমাদের অটিজম আক্রান্ত বাচ্চাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি ।

১। নতুন রুটিন তৈরি করুনঃ প্রথমেই যে কাজটি বাবা-মা করতে পারেন, সেটা হচ্ছে বাচ্চার জন্যে বাসায় নতুন একটি রুটিন তৈরি করা। আমরা জানি যে বেশিরভাগ অটিজম আক্রান্ত শিশুরা ভিস্যুয়াল লার্নার, বা তারা দেখে শেখে। বাচ্চার ডেইলি রুটিনের একটি ভিস্যুয়াল শিডিউল বানানো হলে সেটি বাচ্চাকে বাসার পরিস্থিতি বা পরবর্তীতে করনীয় কাজ বুঝতে সাহায্য করবে। ভিস্যুয়াল শিডিউল হচ্ছে কিছু সারিবদ্ধ ছবি (কোন কোন ক্ষেত্রে লেখাও হতে পারে), যেটিতে কোন কাজের পরে কোন কাজ করা হবে, বা একই কাজের ধাপ গুলোকে বিস্তারিত বর্ণণা করা থাকে।

 

 

ভিসুয়্যাল শিডিউলটি কোন শিডিউল বোর্ড, বাচ্চার নোটবুক বা এমন যায়গায় স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে সহজেই বাচ্চাকে দেখানো যায়। শিশুকে প্রতিটি কাজের আগে ছবিগুলো দেখিয়ে বলতে হবে যে এখন কি করা হবে। যেমন , ধরা যাক একটি বাচ্চার সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কাজ টয়লেট করা। সেক্ষেত্রে ঘুম থেকে ওঠার পর তাকে টয়লেটের ছবিটি দেখানোর পর সে টয়লেটে যাবে।  এভাবে করে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত তার দৈনন্দিন কাজ গুলো ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করুন।  করোনাভাইরাসের এই সময়ে নিয়মিত সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া শেখানো বাচ্চার জন্যে খুবই দরকারী। ভিস্যুয়াল শিডিউলের মাধ্যমে বাচ্চাকে হাত ধোয়ার ধাপগুলো বর্ণনা করতে পারেন। এর ফলে বাচ্চার বুঝতে সুবিধা হবে পরবর্তিতে কি কাজ করতে হবে ও অনাকাঙ্ক্ষিত আচরন কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রনে আসবে।

২। বাসায় একটি স্কুল স্পেস তৈরি করুনঃ যদি বাসায় পর্যাপ্ত পরিমান ফাঁকা জায়গা থাকে, তাহলে বাসায় বাচ্চার জন্যে একটি স্কুল স্পেস তৈরি করে নিতে পারেন। বাচ্চা স্কুলে যে সেটিংস এ বসে কাজ করে, সেরকম একটি সেটিংস বানিয়ে নিতে পারেন। সেটা করতে পারেন ঘরের এককোনায় বা যেখানে পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচলের সুবিধা রয়েছে এমন যায়গায়। এছাড়াও স্কুল সেটিং এ বাচ্চার যেসব পরিচিত ও পছন্দের বস্তু রয়েছে সেগুলো রাখতে পারেন বাচ্চার নতুন স্কুল স্পেসে। যদি বাচ্চা কথা বলতে পারে, তাহলে বাচ্চার কাছ থেকেই প্রশ্ন করে জেনে নিন সে কি কি চায় তার স্কুল স্পেসে।

৩। শুরু করুন বাচ্চার স্কুলের রুটিন অনুযায়ী কাজ দিয়েইঃ ক্লাস টিচার এর কাছ থেকে বাচ্চার I.E.P (Individualized Educational Plan) সংগ্রহ করতে পারেন এবং জেনে নিতে পারেন স্কুলে কি রুটিন অনুযায়ী কাজ করা হয়।   দিনের প্রথম পিরিয়ড বা বিষয় নিয়ে শুরু করতে পারেন এবং ঘরে বসে স্কুল ও শ্রেণিকক্ষে সাধারণত যে বিষয়গুলি এবং ক্রিয়াকলাপ অনুসরণ করা হয় তা অনুসরণ করে একটি “স্কুল-ডে” রীতি তৈরি করে সেটা অনুযায়ী কাজ করতে পারেন।  যেমন, যদি তাদের দিনটি সাধারণত পি,টি দিয়ে শুরু হয়, তাহলে পি,টি দিয়েই শুরু করতে পারেন। স্কুল- ডে শেষ করতে পারেন খাতা-বই গুছানোর মধ্য দিয়ে। ভিস্যুয়াল শিডিউল এর মাধ্যমে স্কুল রুটিন টি প্রকাশ করুন যেন বাচ্চার বুঝতে সুবিধা হয়।

৪। বাচ্চাকে পারিবার এর দৈনন্দিন কাজগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করুনঃ সময় যেন কাটছেই না! এই অফুরন্ত সময়ে বাচ্চাকে ঘরের দৈনন্দিন কাজগুলো শেখানো শুরু করতে পারেন, যেমন- রান্নাঘরের টুকিটাকি জিনিস এনে দেয়া, মোবাইল এনে দেয়া, কাপড় গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে বাচ্চা যদি কাজটি করতে পারে, অবশ্যই তাকে উপযুক্ত রিইনফোর্সমেন্ট দিতে হবে বা পুরস্কৃত করতে হবে। এক্ষেত্রে verbal praise (মৌখিক ভাবে  প্রশংসা করা) বা হাততালি দেয়া যেতে পারে।

৫। নতুন ভোকাবুলারি, কনসেপ্ট শেখানঃ এ সময়টায় বাচ্চাকে নতুন শব্দ বা ভোকাবুলারি ও কনসেপ্ট শেখাতে পারেন। বাচ্চাকে চেয়ারে বসিয়েই যে তাকে নতুন শব্দ শেখাতে হবে তা নয়, বরং বাচ্চা বাসায় যে কাজটিই করছে সেটিকে বাবা মা ধারাভাষ্যর মত বলতে পারেন, যেমন- বাচ্চা যদি গাড়ি নিয়ে খেলতে থাকে, তখন বাবা মা বলতে পারেন “তুমি গাড়ি নিয়ে খেলছো”, “হ্যা- গাড়ি রাস্তায় চলছে” ইত্যাদি। যদি বাচ্চা একশব্দে কথা বলতে পারে, যেমন যদি “গাড়ি” শব্দটি বলতে পারে, তাহলে তার সাথে অন্য আরেকটি শব্দ জুড়ে দিয়ে কথাটাকে আরো বিস্তৃত করতে সাহায্য করতে পারেন , যেমন- “লাল গাড়ি” বা “বড় গাড়ি”। এছাড়াও এ সময়টায় বাচ্চাকে বিভিন্ন ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভোকাবুলারি শেখাতে পারেন, যেমন- পেশা, খাবার-দাবার, ছেলেদের পোষাক, মেয়েদের পোশাক ইত্যাদি।

৬। ফিজিক্যাল এক্টিভিটির উপর নজর দিনঃ যেহেতু অটিজম আক্রান্ত বাচ্চাদের সেনসরি জনিত সমস্যা থাকা খুবই সাধারন, তাই বাচ্চার অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এর সাথে ফোনে বা ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে বাচ্চার জন্যে উপযুক্ত ফিজিক্যাল এক্টিভিটি কি হবে জেনে নিতে পারেন। বাচ্চার সেনসরি ইস্যুর উপর ভিত্তি করে অকুপেশনাল থেরাপিস্ট থেরাপি সেশনে যে কাজ গুলো করাতেন, সেগুলো বাসায় করাতে পারেন। বাসার ছাদ যদি বড় থাকে, সেখানে সাইকেল চালানো শেখানো যেতে পারে, তবে অবশ্যই অন্যান্য মানুষের সাথে দুরত্ব বজায় রেখে  ও সাবধানতা অবলম্বন করে।

৭। বাচ্চার সাথে হাসুন, খেলুন, মজা করুনঃ এসময় যেহেতু বাচ্চা বাইরে যেতে পারছে না এবং রুটিনের প্রচুর হেরফের হচ্ছে, তাই বাচ্চার উদ্বিগ্নতা থাকবে অনেক বেশি। এসময় কোনভাবেই বাচ্চার সাথে জোরাজুরি করবেন না, ধমক দেবেন না। বাচ্চার সাথে প্রাণ খুলে হাসুন, বাচ্চার সাথে বাচ্চার পছন্দের খেলাটি খেলুন। সবসময় যে বাচ্চাকে কোনকিছু শেখানোর জন্যেই খেলতে হবে এমনটিও নয়; বাচ্চার খেলার প্রতি আগ্রহ থাকলে বাচ্চা সেখান থেকেই বেশ কিছু স্কিল শিখে নেবে। বাচ্চার ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ থাকলে তার সাথে ছবি আঁকতে বসে পড়ুন, গান গাইতে পছন্দ করলে গান গাইতে পারেন তার সাথে। মোটকথা হচ্ছে এই হোম কোয়ারেন্টাইন এর সময়টি বাচ্চার জন্যে যেন আনন্দদায়ক হয়, সেটির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

আমাদের হয়ত আরো কিছুদিন সময় লাগবে বিশ্বব্যাপী এই মহামারী থেকে পরিত্রাণ পেতে। ততদিন পর্যন্ত আমাদের সরকারী নির্দেশনা মেনে বাসাতেই অবস্থান করতে হবে। এসময় বাবা-মা দুজনেরই বাচ্চার সাথে সমানভাবে মেশা প্রয়োজন। বাচ্চার জন্যে একটি আনন্দদায়ক ও শিক্ষণীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে এই দুর্যোগের সময়ও বাচ্চার জন্য হয়ে উঠতে পারে সুন্দর ও উদ্বেগহীন।

 

লেখকঃ 

নবাগত দাস 

বিভাগীয় প্রধান, থেরাপিউটিক ইউনিট

ফেইথ বাংলাদেশ

১/১৫ এ, ইকবাল রোড

মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

হটলাইনঃ +৮৮০১৭৮৩২৪৮৪২৩

ওয়েবসাইটঃ  www.faithbangladesh.org/services

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Skip to content