আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক সচরাচর নতুন কিছু শেখার জন্য তৎপর থাকে। কিন্তু এই শেখার ক্ষমতা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়। তেমনি আমরা যদি স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বুদ্ধিগত দিক থেকে বেড়ে ওঠার দিকে নজর দেই, তাহলে দেখব বয়স অনুযায়ী বুদ্ধির বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা অনেকাংশেই পিছিয়ে থাকে। অর্থাৎ যে বয়সে যতটুকু বোঝার দক্ষতা তৈরি হওয়া দরকার তা হয় না। তাদের মানসিক বিকাশ জনিত সমস্যা যতটুকু সম্ভব কমিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য অকুপেশনাল থেরাপিস্টরা Play থেরাপির মাধ্যমে এই শিশুদের বুদ্ধি বিকাশের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কাজ করে থাকেন। Cognitive Development Skill বাড়ানোর জন্য অকুপেশনাল থেরাপিস্টরা যেসকল প্রসেস অথবা প্রক্রিয়া অবলম্বন করে সেগুলো সম্পর্কে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর বাবা-মা কে কিছুটা ধারণা দেয়াই হচ্ছে এই লেখাটির উদ্দেশ্য।
শিশুর চিন্তাশক্তি বিকাশের জন্য করণীয় পদক্ষেপ
প্রথমেই আসি কাদের জন্য এই বিষয়টাকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে-
আমরা যদি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের কথা বলি তাহলে বুদ্ধি বিকাশ জনিত সমস্যায় আক্রান্ত অনেক কন্ডিশনের কথাই চলে আসে। যেমন অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার, ডাউন’স সিনড্রোম, সেরিব্রাল পলসি, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরি , এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অ্যাটেনশন ডেফিসিট ডিজঅর্ডার, ডিসলেক্সিয়া (পড়তে সমস্যা), ডিস্ক্যালকুলিয়া (গাণিতিক বিষয়গুলোতে অপারদর্শিতা), লার্নিং ডিজেবিলিটি বা শিখন অক্ষমতা ইত্যাদি।
Cognitive Skill (বুদ্ধিগত দক্ষতা) বাড়ানোর জন্য যখন কাজ করা হবে, তখন প্রথমেই যেই বিষয়টা দিকে গুরুত্ব দিতে হবে তা হল শিশুটির Eye Contact বা অন্যের চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা। শিশু যদি আই কন্ট্যাক্ট ঠিকভাবে না করে তখন তা বাড়ানোর জন্য কিছু Play-based স্ট্র্যাটেজি ফলো করা যেতে পারে। এমন ভাবে বাচ্চার জন্য কিছু প্লে বা খেলা বাছাই করতে হবে যেগুলোর মাধ্যমে শিশুর eye to eye contact এবং eye to object contact- এই দুইটি দক্ষতাই বৃদ্ধি পায়।
এরপর আসি শিশুদের অনুকরণ করার ক্ষমতা অথবা দক্ষতা কতটুকু আছে সেই বিষয়টির দিকে। অনুকরণ করার দক্ষতা বাড়ানোর একটি এক্টিভিটির উদাহরণ হতে পারে পাজল ম্যাচিং । এক্ষেত্রে আপনি শিশুকে কয়েকবার দেখিয়ে দিন পাজল বোর্ডে একটা ছবি নির্দিষ্ট জায়গায় লাগাতে হয় এবং একই কাজটা শিশুকে পরবর্তী করতে বলুন। মূলকথা অন্যজনের দেখাদেখি একটি কাজ শিশুটি নিজে করতে সক্ষম হচ্ছে কিনা তা দেখা, এবং যদি না পারে তাহলে তাকে করতে সাহায্য করা। Play এর মাধ্যমে ছাড়াও Body Movement Copy বা Imitation (অনুকরণ) করার মাধ্যমে ও শিশুর এই দক্ষতা বাড়ানো যেতে পারে। Eye contact এবং Imitation এই দুটো দক্ষতায় যখন শিশু পারদর্শী হবে , তারপর আমাদের নজর দিতে হবে শিশুটির Attention (মনোযোগ) কিভাবে বাড়ানো যায় সেই দিকে। এখন দেখে নেয়া যাক গড়পড়তা ভাবে Attention Span বা কোন বিষয়ে মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা কোন বয়সের বাচ্চাদের কতটুকু থাকে।
বয়স | গড় মনোযোগের সময়সীমা |
৪ বছর | ৮-২০ মিনিট |
৫ বছর | ১০-২৫ মিনিট |
৬ বছর | ১২-৩০ মিনিট |
৭ বছর | ১৪-৩৫ মিনিট |
৮ বছর | ১৬-৪০ মিনিট |
৯ বছর | ১৮-৪৫ মিনিট |
১০ বছর | ২০-৫০ মিনিট |
১১ বছর | ২২-৫৫ মিনিট |
১২ বছর | ২৪-৬০ মিনিট |
এখন আসি মনোযোগ বাড়ানোর মাধ্যম কি হতে পারে সে সম্পর্কে –
এক্ষেত্রে Play Therapy বিশেষ ভূমিকা রাখে। Graded Play Based Activity এর মাধ্যমে ধাপে ধাপে Attention Span বাড়াতে হবে। উপরে বর্ণিত ছক অনুযায়ী চার বছরের কোন শিশুর অ্যাটেনশন যদি এক মিনিট থাকে তাহলে টার্গেট নিতে হবে প্রথমে ৩/৪ মিনিট, এরপরে ৫ মিনিট এবং ধাপে ধাপে তা বাড়িয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিটে আনার চেষ্টা করতে হবে।
Play এর প্রতি যখন বাচ্চার মনোযোগ বাড়বে এরপর Understanding Level (বোঝার ক্ষমতা) বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে।
এক্ষেত্রে প্রথমে ছোট ছোট বিষয়গুলো বুঝতে শেখাতে হবে। যেমনঃ Object (ব্রাশ, ফ্যান, লাইট) চিহ্নিত করতে পারা, Person (বাবা, মা, ভাই, বোন) Identify করতে পারা ইত্যাদি। এরপর আসবে ছোট ছোট বাক্য বুঝতে সাহায্য করা। যেমনঃ বল দাও, কাছে আসো, দরজা কোথায় দেখাও, ফ্যান কোনটা দেখাও ইত্যাদি।
Understanding Level যখন আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে এরপরে আসবে Instruction Following Skill বাড়ানোর কাজ। দুই ধাপে Instruction Following Skill বাড়ানো যেতে পারে। প্রথম ধাপে সহজ নির্দেশনা অনুসরন করার কাজ (Simple Instruction Following Activity) তৈরি করা যেতে পারে। যেমন, চেয়ারে গিয়ে বসো, আমাকে পাজলবোর্ড এনে দাও, পাজলবোর্ড রেখে আসো ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধাপে, একটু কঠিন নির্দেশনা অনুসরণ করার কাজ (Complex Instruction Following Activity) করাতে হবে। যেমন : পানির বোতল খাবার টেবিলে রেখে আসো, আমাকে দুইটা লাল বল আর একটা হলুদ বল এনে দাও। এই ধরনের কিছু Play Based Task অনুসরণ করানোর মাধ্যমে এই দক্ষতাগুলো বাড়ানো যেতে পারে।
এই পর্যায়ে আসলে শিশুর মেমোরি (মনে রাখার ক্ষমতা) বাড়ানো নিয়ে কাজ করতে হবে। মেমোরি দুই ধাপে বিভক্ত। Short-term Memory (স্বল্প মেয়াদি স্মৃতি) এবং Long-term Memory (দীর্ঘ মেয়াদি স্মৃতি)। Short-Term মেমোরি বাড়ানোর জন্যে নতুন কোন বস্তু / খেলনা এর নাম শেখানোর পর কিছুক্ষণ পর বা কয়েকদিন পর্যন্ত যেন মনে রাখতে পারে, বারবার অনুশীলনের মাধ্যমেই দক্ষতা তৈরি করা যেতে পারে।
Long-term মেমোরির জন্যে শিশু যেন কোন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনার পর বেশ কিছুদিন পর থেকে কয়েক মাস পরে গিয়েও ওই বিষয়টা মনে রাখতে পারে, বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে শিশুর এই দক্ষতাগুলোও তৈরি করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শিশুর লার্নিং ক্যাপাসিটির বা শেখার সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে শিশুর লংটার্ম মেমরি নিয়ে কাজ করতে হবে, যেক্ষেত্রে একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট সাহায্য করতে পারেন।
উপরের দক্ষতাগুলো যারা মোটামুটি আয়ত্ত করতে পারবে তাদের জন্য পরের ধাপগুলো দিকে নজর দিতে হবে। এ পর্যায়ে শিশুদের Cause & Effect সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। সহজ কথায় এর অর্থ হল কোন একটা ঘটনা ঘটলে তার পরিপ্রেক্ষিতে কি করতে হবে তা বুঝতে পারা। যেমনঃ রাস্তায় পিছন থেকে কোন গাড়ি আসছে তা বুঝে সরে যেতে হবে, চোখের সামনে কেউ কিছু শিশুর দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে সাথে সাথে নিজেকে রক্ষা করতে পারা ইত্যাদি। এই দক্ষতাগুলো তৈরি করতে পারলে বুঝতে হবে শিশু Cause & Effect এর ধারণাটি উপলব্ধি করতে পেরেছে।
এরপর Problem Solving এর বিষয়টায় আসি। শিশুর সামনে কোন একটা সমস্যা তৈরি করতে হবে এবং সেটার সমাধান কি হবে তা শেখাতে হবে। যেমনঃ মেঝেতে পানি পড়ে গেলে তখন কি করণীয় সে বিষয়ে ধারণা তৈরি করা। শিশুর Planning করার দক্ষতা তৈরিও শিশুর মানসিক বিকাশের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। এই স্কিলটা তৈরি করার জন্য যা করা যেতে পারে, তা হচ্ছে শিশুর সাথে আলোচনা সাপেক্ষে প্ল্যান করা যে সে কি কি কাজ সে করতে চায় এবং পরবর্তীতে তাকেও প্ল্যান করতে দিতে হবে। সারা দিনে সে কি কি করতে চায় বা স্কুল শেষে বাসায় গিয়ে পর্যায়ক্রমে কি কি করতে চায়, তা প্ল্যান করার সুযোগ করে দিতে হবে। নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে শিশুর প্ল্যানিং করার দক্ষতা তৈরি করা যেতে পারে।
পরিশেষে আসবে Decision-Making স্কিল তৈরি করা। যেমন ধরুন, শিশুর সামনে অনেকগুলো অপশন থাকবে এবং শিশু তার মতো করে তার জন্য কোনটা বেশি উপযুক্ত হবে তা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে- এটাই হলো Decision-Making। এটা অনেক হাই ফাংশনিং একটা স্কিল। বলা বাহুল্য যে এই স্কিলটাতে সাধারন অনেক মানুষেরই কম বেশী সমস্যা থাকে। তাই শিশুর ক্ষেত্রে সেই দিকটি মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।
আশা করা যায় যে উপরোক্ত ধাপগুলো অনুসরণ করে বুদ্ধির বিকাশ জনিত সমস্যায় শিশুদের সাথে কাজ করলে অনেক উন্নতি সাধন করা যাবে। প্রয়োজন শুধু ধৈর্য্য, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং হাল না ছাড়ার প্রত্যয়।
লেখিকাঃ
তুলি ধর
সিনিয়র ক্লিনিক্যাল অকুপেশনাল থেরাপিস্ট
ফেইথ বাংলাদেশ
১/১৫ এ, ইকবাল রোড
মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
হটলাইনঃ +৮৮০১৭৮৩২৪৮৪২৩
ওয়েবসাইটঃ www.faithbangladesh.org/services